তৃষিয়ার অগ্নি-যাত্রা

শুরুটা হয়েছিলো কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য থেকে। সেটা ২০১১ সালের কথা। কাজ খুঁজতে গিয়ে নারী প্রকৌশলী হিসেবে তৃষিয়া নাশতারান বৈষম্যের মুখে পড়ছিলেন বারবার। কাজ পেয়েও সেই বৈষম্য শেষ হয়নি। বরং নারী বসের দুর্ব্যবহার দেখতে হয়েছে নারীবিদ্বেষের রূপে। কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত টয়লেটটির তালা খুলে দিতে বলেছিলেন তৃষিয়া। জবাবে বস তারস্বরে বলেছিলেন অফিসে নারী কর্মী রাখাটা তার ভুল, কারণ নারীদের নানান ‘নখরা’। একজন নারীর এহেন নারীবিদ্বেষী আচরণ তৃষিয়ার মনোজগতে তুমুল নাড়া দেয়। তিনি এ ব্যাপারে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করতে থাকেন। অনলাইনে বিভিন্ন কমিউনিটিতে যুক্ত থাকলেও সেসব জায়গায় এই বিষয়ে আলাপ তুলতে ইচ্ছে হয়নি তার। কারণ সেই কমিউনিটিগুলোতে নারীবিদ্বেষ তিনি আগেই দেখে এসেছেন। একান্ত নিজের প্রশ্ন আর ক্রোধ প্রকাশের জায়গা খোঁজার তাড়না থেকে ২০১১ সালের জুনে ফেইসবুকে ‘মেয়ে’ নামে একটি গ্রুপ খোলেন তৃষিয়া। সেখানে আমন্ত্রণ জানান চেনা মহলের সকল নারীকে। সেখানে নিজের গল্প বলতে শুরু করেন তিনি। গল্প করতে করতে দেখা গেল এমন বৈষম্য বা অন্যায়ের শিকার তৃষিয়া একা নন। আরো অনেকের জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে। তারাও প্রশ্ন করার, কথা বলার জায়গা খুঁজছিলেন। সমমনা এই মানুষগুলোর দৈনন্দিন গল্প থেকে মেয়ে গ্রুপ বড় হতে থাকে। পাঁচ বছরের পরিক্রমায় মেয়ে গ্রুপ হয়ে ওঠে ‘মেয়ে নেটওয়ার্ক’। আর দশ বছরের মাথায় এই নেটওয়ার্কের পথ ধরেই নিবন্ধিত হয় অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (OGNIE Foundation Bangladesh)।

গ্রুপ থেকে নেটওয়ার্ক আর নেটওয়ার্ক থেকে ফাউন্ডেশন – এত সরলরৈখিক ছিলো না পথটা। অনলাইনে আর অফলাইনে অনেক প্রকল্প, অনেক উদ্যোগ, অনেক উত্থানপতন, সাফল্য আর ব্যর্থতা জড়িয়ে আছে মেয়ে তথা অগ্নির যাত্রাপথে। কর্মক্ষেত্রে জেন্ডারের বৈষম্য থেকে শুরু হলেও ‘মেয়ে’-কে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগে নারীর জীবনের অনেকগুলো বাধা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে, এখনো করতে হচ্ছে নিয়মিত। এর মধ্যে রয়েছে যৌন সহিংসতা, উপার্জনহীনতা, ঘরেবাইরে নিত্যনৈমিত্তিক বৈষম্য এবং পিতৃতন্ত্রের আধিপত্য। তথ্যের অভাব, যোগাযোগের ঘাটতি এবং নিরাপদ স্থানের সংকট দূর করার কাজ করতে গিয়ে কর্মপরিবেশ বদলানোর জন্য কাজ করার সময় আর জনবলে টান পড়ে যাচ্ছিল বারবার। এই সমস্যা নিরসনে মেয়ে নেটওয়ার্কের নিয়মিত সেবাগুলোকে কাঠামোগত রূপ দিতে অগ্নি ফাউন্ডেশন শুরু হয়। করোনাকালে বিপন্ন মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে বড় অংকের আর্থিক লেনদেনের প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই বর্ধিত হিসেবের স্বচ্ছতা রক্ষা করাও অগ্নির পত্তনে প্রেরণা জুগিয়েছে।

অগ্নি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তৃষিয়া নাশতারান।

‘মেয়ে’র সূচনার দশ বছর পূরণ হলো গত জুনে। মেয়ে নেটওয়ার্ক এখন আগের থেকে দৃঢ় এবং সুসংহত হয়েছে। তবে এতগুলো বছরেও কর্মজীবী নারীর পেশাগত দৃশ্যপটে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি, যা নেটওয়ার্কের সদস্যদের গল্প থেকে উঠে আসে। তৃষিয়া আশা করেন অগ্নির মাধ্যমে এই শূন্যতা পূরণে গঠনমূলক কিছু কাজ করা সম্ভব হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মচারীদের অনেকেই বিয়ে কিংবা মাতৃত্বের পর আর কাজ করতে পারেন না। এর দায় সিস্টেমের উপর বর্তায় বলে মনে করেন তৃষিয়া। তিনি বলেন, “ঘরেবাইরে কোনোখানেই সাপোর্ট না পেলে একজন নারীর জন্য কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। দেখা যায় একজন চাকুরিজীবী মা ঘরের কাজে কিংবা সন্তান পালনে পরিবারের সদস্যদের সহায়তা পাচ্ছেন না। অফিসও তার ভার লাঘব করতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং নতুন মায়ের উপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে কিংবা বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করে তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করছে। মায়ের জন্য যদি তার অফিসে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বাড়িতে সাহায্য না পেলেও অন্তত অফিসে সেই কমতি পূরণ হতে পারে। তাছাড়া দারিদ্র্যপীড়িত নারীদের প্রতি বৈষম্য বা অবমাননা নিয়ে অনেকেই কাজ করতে আগ্রহী হয়। আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষিত ও সুবিধাপ্রাপ্ত নারীর প্রান্তিকতা নিয়ে ভাবার মতো প্রতিষ্ঠান কমই আছে। এইখানটাতেই ‘অগ্নি’র কাজ হবে। অগ্নি শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে সকল মানুষের জেন্ডারভিত্তিক প্রান্তিকতা নিয়ে কাজ করবে।”

সুবিধাপ্রাপ্ত নারীও যে স্থানভেদে প্রান্তিক হতে পারেন তা অনেকেই মানতে চান না। এজন্য মেয়ে নেটওয়ার্কে মধ্যবিত্ত নাগরিক নারীদের জীবন থেকে উঠে আসা কঠোর বাস্তবতার গল্পগুলোকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তৃষিয়া। তিনি বলেন, “আমাদের গল্পগুলোই আমাদের যাপিত প্রান্তিকতার সাক্ষ্য বহন করে। মেয়ে নেটওয়ার্ক থেকে উঠে আসা গল্পগুলো সবার সামনে না এলে মানুষ বুঝবেই না যে সমস্যার গভীরতা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত!”

এই গল্পগুলোকে কাজে রূপান্তরিত করতে যথাযথ পড়ালেখা, গবেষণা ও পরিসংখ্যানের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন তৃষিয়া। সেজন্য ২০১৮ সালে তিনি প্রকৌশলপেশা ত্যাগ করে কানাডায় গেছিলেন পড়াশোনা করতে। সেখানে তিনি অকাড ইউনিভার্সিটিতে স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট এন্ড ইনোভেশন নামের ডিজাইন প্রোগ্রামে মাস্টার্স করে দেশে ফিরেছেন গত বছর। তার মাস্টার্সের গবেষণাপত্রের বিষয় ছিলো পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকেন্দ্রিক সংগঠনের ভবিষ্যত। তৃষিয়ার কেইসস্টাডি ছিল মেয়ে নেটওয়ার্ক। তৃষিয়া জানালেন, “জেন্ডার নিয়ে কাজ করব বা ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করবো এমন পরিকল্পনা শুরু থেকে ছিলো না। প্রয়োজন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি মনে করি পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় জেন্ডার ইনক্লুসিভ ভবিষ্যৎ গঠনের বিকল্প নেই। আমি পড়েছি স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট যেটা কিনা কোনো মুভমেন্ট, প্রতিষ্ঠান, পলিসি বা সেবার ভবিষ্যত নিয়ে গবেষণা করে, ভবিষ্যত রূপরেখা তৈরি করে। আমার মাস্টার্সের গবেষণার অংশ হিসেবে আমার উপলব্ধি জাগে যে দেশে ফিরে সংগঠনের কোনো আইনসিদ্ধ পরিচয় গড়তে হবে, এবং কাঠামো ও স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে। ‘অগ্নি’ নামটা তখনো মাথায় আসেনি। শুধু ভাবনাটা ছিলো মনে। আমি এমন একটা প্রতিষ্ঠান শুরু করতে চেয়েছিলাম যার কাজ হবে জেন্ডারকেন্দ্রিক গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে জেন্ডার ইকুইটিতে পৌঁছানোর জন্য দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা। আর সেজন্য শুধু নারী নয়, বরং সকল জেন্ডারের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। ‘অগ্নি’ সেই জেন্ডার-ইনক্লুসিভ এবং ফোকাসড কাজগুলোই করবে। এখন আমি নিজেকে একজন নারীবাদী সংগঠক, একজন ডিজাইনার এবং ফোরসাইট স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করি।  আমার প্রকৌশলী পরিচয়টা মিশে গেছে ডিজাইনার পরিচয়ের ভিতরে এবং প্রযুক্তি নিয়ে আমার কাজের মধ্যে।”

মেয়ে নামেই কেন নিবন্ধন করা হলো না? অগ্নি নামে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তৃষিয়া বললেন, “বেশ কিছু কারণ বিবেচনা করে আমরা ভিন্ন নামে নিবন্ধন করেছি। এর মধ্যে রয়েছে নামের দুর্বোধ্যতা, সামাজিক অসংবেদনশীলতা এবং লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট রাখার প্রয়োজনীয়তা। মেয়ে শব্দটা খুব সহজ হলেও নেটওয়ার্কের বাইরে কেউ সহজে বুঝতে পারেন না। বারবার জিজ্ঞেস করেন কিংবা বানান করে বুঝাতে হয়। তাছাড়া মেয়ে নাম শুনলে অনেকসময় ছেলেরা সেখানে আসতে চান না। অথচ আমি চাই নারীপুরুষসহ সকল জেন্ডারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। সেই সঙ্গে শুধুমাত্র জেন্ডার নিয়ে কাজ করবে এই ফোকাসটা রাখা জরুরি। তাই অনেক ভেবে OGNIE নামটা ঠিক করা হয়েছিল গত বছরের মার্চ মাসে। OGNIE’র সম্পূর্ণ রূপ হলো Organizing Gender Narratives for Inclusivity and Equity। নাম ঠিক করার পর দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে এ বছরের এপ্রিল মাসে অগ্নি নিবন্ধিত হয়েছে অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামে। নাম নতুন হলেও অগ্নির কাজ মেয়ে নেটওয়ার্কে নতুন কিছু না। মেয়ে নেটওয়ার্কের অন্যান্য শাখাগুলো, যেমন সিস্টারহুড (জেন্ডারভিত্তিক সেবা ও সহায়তা), সন্ধি (দুর্যোগকালীন স্বেচ্ছাসেবা), রাঙতা (উদ্যোক্তা-নির্মাণ) ইত্যাদির কাজগুলোকে ইনক্লুসিভ ভবিষ্যত অভিমুখে পরিচালিত করতে প্রয়োজনীয় গবেষণা, প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনাটা অগ্নি করবে। আমাদের থাকবে ডাক্তার, থেরাপিস্ট, আইনজীবীদের উপস্থিতিতে প্রফেশনাল প্যানেল। আমাদের সার্ভিস হবে জেন্ডার সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল। ছোট, বড়, মাঝারি আকারে উদাহরণ সৃষ্টি করে সমাজে প্রভাব তৈরির মাধ্যমে জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিংয়ের কাজ করবে অগ্নি ফাউন্ডেশন। নারীবাদের দৈনন্দিন চর্চা এবং প্রযুক্তির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মেয়ে নেটওয়ার্কের চিন্তা ও কাজকে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে আমরা অগ্নিকে গড়ে তুলতে চাচ্ছি। আমাদের এই বর্ণাঢ্য যাত্রায় আমাদের নেটওয়ার্কের মধ্য থেকে উঠে আসা স্বেচ্ছাসেবী, উদ্যোক্তা আর স্পন্সরদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মেয়ে নেটওয়ার্ক স্বাবলম্বী হয়েছে, আরো বড় পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস করতে পেরেছে। মেয়ে নেটওয়ার্কের সদস্যদের এই আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক অংশগ্রহণগুলোই অগ্নির চালিকাশক্তি।” মেয়ে নেটওয়ার্কের এতদিনকার সব কাজকে এক সুতোয় গেঁথে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের মসৃণ পথ সৃষ্টি করবে অগ্নি ফাউন্ডেশন, এই প্রত্যাশায় এগিয়ে চলছেন তৃষিয়া নাশতারান।

অগ্নির ফেইসবুক লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/ogniebd/

শেয়ার করুন