নান্দনিক ‘আরুণিকা’

'আরুণিকা'র উদ্যোক্তা অরুণিতা ঘোষাল

সৃজনশীল কাজ মাথার ভেতর মৌমাছির মত ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই কাজের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ না পায়, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন শান্তি নেই। অরুণিতা ঘোষালেরও হয়েছে এই অবস্থা। তার উদ্যোগ ‘আরুণিকা’র একেকটা কাজের চিন্তা যখন মাথায় আসে তখন তার ঘুম হারাম হয়ে যায়। মাথার ভেতরেই চলতে থাকে ডিজাইন, রং, কাঁচামাল ইত্যাদি হাজারো চিন্তার আনাগোণা!! আর চলবেই বা না কেন? আরুণিকার পণ্যের ধরণ দেখলেই তা সহজে অনুমেয়। প্রিয়জনের জন্য নিজেদের ছবির পাজল দিয়ে খেলবেন, বসার ঘরের দেয়াল ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে চলে যাবেন তুমুল হলুদ সূর্যমুখীর বনে কিংবা রাতের তারার রেখা ধরে চলবে ঘড়ি টিকটিক। প্রিয় লুডো বোর্ডটা হবে নিজেদের প্রিয় মুহূর্তের ছবি দিয়ে, অথবা সৌরজগতের গ্রহ নক্ষত্রের সাথে ঘুরতে পারবেন ‘আরুণিকা’র সাথে।

ছোটবেলার শখটিকেই আজ নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিতে পেরে দারুণ তৃপ্ত তরুণ উদ্যোক্তা অরুণিতা। যদিও এ পর্যন্ত আসার পথটা মোটেও মসৃণ ছিলনা তার জন্য।

“কেন যেন সৃজনশীল কাজগুলোকে শুধুই শখের কাজ হিসেবে গণ্য করে সবাই। পরিপূর্ণ পেশা হিসেবে মেনে নিতে পারেনা অনেকেই। আমার পরিবারের কাছেও তাই আমার কাজের স্বীকৃতি শখ পর্যন্তই। পেশা হিসেবে ব্যবসা করছি আবার তার মাধ্যম হচ্ছে আমার শখ, এটা মেনে নিতে এখনো পারেনি আমার পরিবার।’-বলছিলেন অরুণিতা।

কিন্তু নিজের কাজের সহযোগী হিসেবে সবসময়ই পাশে পেয়েছেন বন্ধু ও সহধর্মী দেবাশীষ রায় ডেভিড-কে। অরুণিতা ঘোষালের  ‘আরুণিকা’ কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এ মানুষটিও।

“বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার কিছু বন্ধু যাদের মধ্যে একজন ছিলেন দেবাশীষ, বুয়েটে স্থাপত্য বিভাগে পড়তেন। ওদের কাজের জন্য নিউমার্কেটে যাওয়া হতো প্রায়ই। ওদের সাথে কাজের জিনিস কিনতে গিয়েই একদিন নিজের জন্য কিছু জিনিস কিনে আনলাম। তখন কিছু কাগজের ক্রাফটিং করে খুব প্রশংসা পাই। এরপর কাঠ দিয়ে গহনা বানানো শুরু করি। কিন্তু সেসময় ক্রাফটিং এর জন্য কাঁচামাল খুচরা আকারে বিক্রি হতোনা, লট আকারে কিনতে হতো। তাই অনেক কাঁচামাল জমতে থাকলো। সেজন্য ২০১৬ সালে একটা পেইজ খুললাম মূলত: ক্রাফটস আইটেম বিক্রির উদ্দেশ্যে। নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাম দিলাম ‘আরুণিকা’। এরপর নোটবুক, লুডোবোর্ড, দাবাবোর্ড, স্কেচবুক, দেয়াল ঘড়ি, পেইন্টিং সহ নানা পণ্য যোগ হতে থাকে আমার উদ্যোগে। লট আকারে কেনা সব কাঁচামাল নিজেরাই ব্যবহার করতে থাকি। এখন পর্যন্ত নিজেদের কারখানা গড়ে না উঠলেও কাঠের বা প্রিন্টিং এর কাজ করে এমন বিভিন্ন কারখানায় আমাদের কারিগর আছেন, যারা আমাদের কাজগুলোর কাঠামো বানাতে সাহায্য করেন। এরপর বাকী কাজ আমরা আমাদের বাড়ির স্টুডিওতেই করি।’-জানান অরুণিতা।

‘আরুণিকা’ থেকে নিজের পছন্দের যেকোন ছবি দিয়েই বানাতে পারবেন এমন পাজল

অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকেই ভুল ধারণা পোষণ করে যে এই কাজে তেমন কোন শ্রম দিতে হয়না। কিন্তু এ ধারণার সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে অরুণিতা বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনলাইন উদ্যোগ গুলোর আলাদা অফিস বা কারখানা না থাকার ফলে এই ধারণা গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু আদতে এই নিজস্ব সেটআপ না থাকার জন্যই কাজটাও বেড়ে যায়। কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে কারখানা থেকে প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে সে কাজ আবার সম্পূর্ণ করে তা গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সবকিছুই নিজেদের করা লাগে। আর তাই খাটুনী বা ব্যস্ততাটাও কোন অংশে কম না। সেই সাথে আছে প্রত্যেকটা কাজের আগে পড়াশোনা ও গবেষণা।  একটা থিম ডিসাইড করার পর তা কোন প্রোডাক্টে অ্যাপ্লাই করলে ভাল হবে সে অনুযায়ী সেট করি। রং নির্ধারণ করি। সেগুলো আকার অনুযায়ী করিয়ে এনে তার উপর ডিজাইন করি। প্রতিটি পণ্য বানানোর পর আগে নিজেরা ব্যবহার করে শতভাগ নিশ্চিত হবার পরই তা বাজারে ছাড়া হয়। এ কাজগুলো কোন অংশেই অন্যান্য যেকোন মেইনস্ট্রিম উদ্যোগের চেয়ে কম পরিশ্রমের নয়।”

শিশুদের জন্য এমন শিক্ষামূলক বিভিন্ন হাতে তৈরি খেলনা পাওয়া যাবে ‘আরুণিকা’তে

আরুণিকা-র কাজের মাধ্যম মূলত কাঠ এবং রং। আর কাঠের মান, স্থায়িত্ব ইত্যাদি মিলে আছে অনেক রকমফের। তাই ভাল কিছু দেয়ার দায়বদ্ধতাটাও যেন একটু বেশি।

“আরুণিকার মূল গ্রাহকরা দেশি পণ্যের ক্রেতা। সেই সাথে তাদের রুচিবোধ নান্দনিক। এই গ্রাহকেরা আমাদের জন্য খুবই স্পেশাল। আমাদের এই দেশী পণ্যর ক্রেতা মূলত: পেয়েছি মেয়ে নেটওয়ার্কের ব্যবসায়িক গ্রুপ ‘হুটহাট’ থেকে। এই প্ল্যাটফরমে একটা সমমনা এবং আস্থাভাজন ক্রেতা শ্রেণীর সমাহার ঘটে, যাদের জন্য কাজ করে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এই ক্রেতাদের কাছে তাই মানসম্পন্ন পণ্য পৌঁছে দিয়ে তাদের আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে পারাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর সেজন্য ব্যবসায়ে সততা আমাদের প্রথম শর্ত।’

যেকোন উদ্যোগের জন্য কাছের মানুষদের সহযোগিতা ও সমর্থন অনেক বেশি জরুরী বলে মনে করেন অরুণিতা। নিজের উদ্যোগের ক্ষেত্রে এই জায়গাটাতেই তিনি  শূণ্যতা অনুভব করেন মাঝে মাঝে। আর তাইতো সেই সমর্থনের আশায় নিজের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও সমান প্রচেষ্টার সাক্ষর রেখে চলেছেন তিনি। তবু নিজের এই প্যাশন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননা যেকোন মূল্যে। নারীদের ক্ষেত্রে পেশা হিসেবে ব্যবসাকে এখনো স্বীকৃতি না দেয়ার মানসিকতা রয়ে গেছে এ সমাজে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ এখনো অমসৃণ। তাই নিজের কাজ দিয়েই সেই অমসৃণ পথে দৃপ্ত পদচারণার মাধ্যমে নিজের এবং নিজের উদ্যোগের অবস্থান স্পষ্ট করতে চান অরুণিতা।

ফেইসবুক পেইজের লিঙ্কঃ https://web.facebook.com/aarunikaa

শেয়ার করুন