কাঁথাস্টীচ শাড়িতে গ্রামবাংলার গল্প বলে নকশিয়ানা

নিজের ডিজাইন করা নকশিকাঁথা স্টিচের শাড়িতে মডেল হয়েছেন লিজা।

‘বেশিরভাগ বাঙালি মেয়ের মতো আমিও শাড়ি পরতে ভীষন ভালবাসি। শুধু শাড়ি পরতে না, শাড়ি নিয়ে পড়তেও ভালোবাসি। বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত শাড়ি ও শাড়ির নকশা সম্পর্কে জানতে আমার ভালো লাগে । নিজের শাড়ির নকশা নিজেই করি ৷ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেকেই আমার নকশায় তৈরি শাড়ির প্রশংসা করতো, বানিয়ে দিতে বলতো। বানিয়ে দিতাম। এরপরই আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়তে থাকে। আমি রোকেয়া হলে থাকার সুবাদে হলের অনেকেই আমার কাছ থেকে শাড়ি বানিয়ে নিতো।

এরপরই চিন্তা করি তাহলে এটাকে ব্যবসায়িক রূপ দিচ্ছি না কেন? যেই ভাবা সেই কাজ, ফেসবুকে একটা পেইজ খুলে ফেললাম। যেহেতু আমি নিজে নকশা করি তাই পেইজের নাম দিলাম ‘নকশিyana’ আর দেশীয় সুতি, কোটা, তাঁত শাড়িতে নিজের নকশায় কাঠব্লক করে নকশা করতে লাগলাম ৷ এভাবেই আমার শাড়ির ব্যবসার পথচলা শুরু হল।’

বলছিলেন অনলাইনভিত্তিক পোশাক বিক্রির প্রতিষ্ঠান নকশিyanaর উদ্যোক্তা ও ডিজাইনার সুমাইয়া কাফী লিজা। সালোয়ার-কামিজ ও অন্যান্য পোশাকের পাশাপাশি কাঁথাস্টীচ শাড়ির নতুন ধারনা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন জামালপুরের মেয়ে লিজা। ২০১৬ সাল থেকে গুটি গুটি পায়ে পথ চলতে চলতে তার ব্যবসাটি এখন পাঁচ বছরে পা দিয়েছে।  

লকডাউনে ব্যবসায় মন্দা নেমে আসার আশংকা থাকলেও তিনি জানান, বরং এই সময়ে মানুষের অনলাইনে কেনাকাটা আরো বেড়েছে। অন্য সময়ের চেয়ে বিক্রি বেশি হচ্ছে। আমার কাজের চাপও বেড়েছে।

লিজা তার নকশিyana সম্পর্কে আরো বলেন, ‘জামালপুর জেলার কোনো বিখ্যাত বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে, জামালপুরের মেয়ে হিসেবে প্রথমেই বলি নকশিকাঁথার কথা। নকশিকাঁথার মাধ্যমে বেঁচে আছে বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। এটি বহু মানুষের জীবন-জীবিকার চালিকাশক্তিও বটে। আমি জামালপুরের মেয়ে এটা শোনার পর বেশিরভাগ মানুষ কাঁথাস্টীচ জামা ও নকশিকাঁথার আবদার করতো। তাদের আবদার মেটাতেই নকশিyana নামের আমার ছোট্ট অনলাইন বিপণীতে কাঁথাস্টিচ জামাও রাখতে শুরু করলাম।

এরপর আমি কাঠব্লক ডিজাইনের পাশাপাশি কাঁথাস্টীচে শাড়ি নকশা করতে শুরু করি। কাঁথাস্টীচ শাড়ি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম গতানুগতিক ফোঁড় এবং নকশায় শাড়ি তৈরী হয়। কাঁথাস্টীচের কামিজ ও নকশিকাঁথার যতো কদর, শাড়ির কদর তারচেয়ে অনেক কম। অথচ, জামদানীর মতো কাঁথাস্টীচ শাড়িও একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী দেশী শাড়ি। ফিউশন করার ভাবনা থেকে গতানুগতিক নকশার বাইরে অন্যান্য ফোঁড় আর একরঙা শাড়িতে একই সুতা ব্যবহার না করে বাহারি রঙের সুতার কাজ নিয়ে এলাম একেকটি শাড়িতে। এইবার কাঁথাস্টীচ শাড়ি নিয়েও বেশ সাড়া পেতে শুরু করলাম।

অনলাইনে আমি আমার নকশিyana নিয়ে কাজ শুরু করেছি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ থেকে । পড়াশোনা চলাকালীন কেউ কিছু না বললেও মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরে যে কথাগুলো বেশি শুনেছি তা হলো-  “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কি শেষমেষ শাড়ি-জামা বেচবি! এসব অনলাইন বিজনেস শখে করা যায়, এর উপর ক্যারিয়ার দাঁড় করানো যায়না। এসব বাদ দিয়ে পড়াশোনা কর, বিসিএসটা ঠিকমতো দে। কী এমন কাজ করিস যখন-তখন এখানে সেখানে যেতে হয়! সারাদিন অনলাইনে কি করিস! এসব শাড়ি জামা বিক্রি করবি নাকি সারাজীবন!” আমার বন্ধুবান্ধব, পরিবারের লোকজন সবার এই এক কথা। মেয়ে হয়ে ব্যবসা করাটা তো আরো কঠিন। যখন বাবা-মা’কে বুঝিয়ে নিয়েছি তখন আত্মীয়-স্বজন প্রতিনিয়ত তাদেরকে কথা শোনাচ্ছে। “মেয়ে ব্যবসা করবে! মেয়েকে থামাও।”

সবকিছু মেনে নিয়েই আমি কাজ করে যাচ্ছি। এই ক’বছরে আমি এক সাথে খুব কম পণ্য তৈরি ও বিক্রি করেছি । যেহেতু কর্মী নিয়োগের মতো আমার ব্যবসার অবস্থা হয়নি, তাই অনেক সময় মাসের পর মাস কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে । এর পেছনে রয়েছে ব্যবসা নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা। যেহেতু ছাত্র থাকা অবস্থায় ব্যবসায় শুরু করেছি তাই আমার মূলধন খুবই স্বল্প। বৃত্তির টাকা, টিউশনির টাকা, হাতখরচা, বিভিন্ন জায়গায় খুচরা কাজ যেগুলিকে ইন্টার্নশীপ ঠিক বলা যায়না; এসব জমিয়ে, বাঁচিয়ে ব্যবসায় খাটাতাম ।

পণ্যের কোয়ালিটির সাথে কোনোধরণের কম্প্রোমাইজ নয়, এটিই আমার প্রধান ভাবনা। যেকোনো মূল্যে আমি সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। হালাল রুজিতে আমি এক টাকা উপার্জন করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু কাউকে ঠকিয়ে দশ টাকা উপার্জন করতে চাইনা। আমি আমার ক্রেতাকে পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বলি। কোনো ত্রুটি থাকলে কিংবা পণ্যটি কীভাবে ব্যবহার করলে ভালো হবে সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করি । এবং নিঁখুত কাজটা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা কররি । আমি কোনো তাড়াহুড়ো করি না । সাফল্য আজ না আসুক কাল আসবে । আমার কাজ ভালো হলে একদিন মানুষ আমাকে খুঁজে বের করবে । আমি শুরু থেকে এই কয়েকটা বিষয়ে শক্ত থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বিভিন্ন বিদেশী শাড়ি-থ্রিপিসে যখন বাজার দখল হয়ে আছে তখনো মানুষ দেশী পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। জামদানী, মণিপুরী শাড়িগুলো জনপ্রিয় হয়েছে শাড়িপ্রেমীদের কাছে৷ আজকাল দেশীয় পণ্যের কদর বাড়ছে, বিদেশে থেকে শাড়ির অর্ডার আসে প্রচুর। দেশের কয়েকটি অঞ্চলে নকশীকাঁথাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হস্ত ও কূটিরশিল্পের বাজার। দেশীয় শিল্প, বাংলার লোকসংস্কৃতি আর গ্রামীণ কূটির শিল্পের একটি বড় জায়গা দখল করে আছে এই কাঁথা। আমি স্বপ্ন দেখি কাঁথাস্টীচ শাড়িও একদিন অন্যান্য শাড়ির সমান গুরুত্ব পাবে এবং জনপ্রিয় হবে। শাড়িপ্রেমীদের আলমিরায় অন্তত একটি হলেও কাঁথাস্টীচ শাড়ি শোভা পাবে! নিজ জেলার; সর্বোপরি দেশের এই ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প নিয়ে কাজ করে যে আনন্দ পাচ্ছি সেটিই নকশিyana থেকে আমার সবচাইতে বড় প্রাপ্তি।’

নকশিyanaর ফেইসবুক পেইজের লিংক: নকশিyana

শেয়ার করুন