‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ ও নারীর পণ্যায়ণ

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গর্ব করে আমরা বলে থাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী একজন নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও একজন নারী। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আসনে নারীদের অবস্থান। কিন্তু আমরা কি জোর দিয়ে বলতে পারি নারী তার সঠিক মর্যাদা পেয়েছে? সম্প্রতি ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’প্রতিযোগিতাকে ঘিরে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরী’র মুকুট পরা একজন নারীকে যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বলা যায়, ‘না’, এদেশে এখনও নারীরা উপযুক্ত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়নি।

পুরুষ নির্মিত সমাজে নারীরা আগে যেমন পণ্য ছিলো এখনো তারা পণ্য হয়েই আছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধু এর ধারাটিই পাল্টেছে। এখনো তাদেরকে উপস্থাপন করা হয় পণ্য হিসেবেই-তবে একটু ভিন্নভাবে-প্রগতির মোড়ক দিয়ে পেঁচিয়ে। বর্তমানের এই ‘বিজ্ঞাপনের পণ্য’ হওয়াকে কেউ কেউ নারী স্বাধীনতা বলেও চালাচ্ছেন!

নারীর এই পণ্যায়নে কেবল আয়োজক সংস্থা অন্তর শোবিজের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরীই নন, দোসর হন জুয়েল আইচ, শম্পা রেজা, বিবি রাসেল, চঞ্চল মাহমুদ, রুবাবা দৌলা ও সোনিয়া বশির কবির। ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফিনালের বিচারক ছিলেন এই মহামহিম ব্যক্তিগণ!

সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পৃথিবীতে বিতর্ক চলছে। অনেকে এর বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে, সাদা-কালো, লম্বা-বেটে নানান ধরনের মানুষ আছে পৃথিবীতে। নারী কি পুরুষ সকল মানুষই বিভিন্ন অবয়বে সৃষ্ট। মানুষের চেহারা বা আকৃতি তার নিজের তৈরি করা জিনিস নয় বরং এটি প্রকৃতিসৃষ্ট।

সেজন্য কাউকে খারাপ চেহারার বলে ভর্ৎসনা করা, হিংসা করা বা গালি দেয়া মস্ত বড় অন্যায়। তেমনিভাবে আরও বড় অন্যায় কাউকে নির্দিষ্ট কিছু ক্যাটগরির ভিত্তিতে ‘সুন্দরী’হিসেবে চিহ্নিত এবং পুরস্কৃত করা, কারণ এতে ‘অসুন্দরী’ মানুষেরা মনে গভীর কষ্ট পেয়ে থাকে।

সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে এখনও প্রবল বিতর্ক থাকলেও গোটা বিশ্বজুড়ে বর্তমানে এটি আগ্রহ এবং উন্মাদনার একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে রয়েছে নারীকে পণ্যে পরিণত করার পুঁজিবাদী মতলব। ‘মিস ইউনিভার্স’কে মূলত একটি ব্যবসা বলা যেতে পারে। আর এই ব্যবসার পণ্য হয়ে থাকেন সুন্দরী নারীরা।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নারীদের সমমর্যাদার বিষয়ে সোচ্চার আলোচনা চললেও নিয়মিত ‘মিস ইউনিভার্স’আয়োজনের মাধ্যমে নারীদেরকে ব্যবসায়িক পণ্য বানানোর প্রক্রিয়াও অব্যাহত রয়েছে।

অবশ্য কর্পোরেট পুঁজিবাদ কেবল নারী নয়, সবাইকেই পণ্য বানায়, ক্রেতা বানায়। হয় তুমি বিক্রি করবে নয় তুমি বিক্রি হবে। কারণ এই মতবাদের মূলে আছে শুধুই লাভ, কেবল সাপ্লাই আর ডিমান্ড। ভোগ আর ভোগ। পুঁজিবাদ মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় না, ভোগ করতে শেখায়।

কেউ যদি ভাবে, আমার একটি দামি ফোন কেন লাগবে? কী লাভ? আরেকটা গাড়ি কেন লাগবে? ঐশ্বরিয়া কেন, আমার পাশের বাসার জরিনা-কুলসুমও তো সুন্দরী! বারো শ টাকা দিয়ে পিৎজা কেন খাব? গ্লোরিয়া জিন্সে আটশ টাকা দিয়ে এক কাপ কফি খাওয়ার যুক্তি কী? অ্যাডিডাসের জুতো, কেলভিন ক্লেনের শার্ট লাগবে কেন? শার্ট তো শার্টই!

সেই মুহুর্ত থেকে আপনি পুঁজিবাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠলেন। পুঁজিবাদ চিন্তাবিদ চায় না। চায় ক্রেতা। যে খালি কিনবে আর কিনবে। আসলেই দরকার আছে কি নেই, এই সব নিয়ে ভাববে না। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে শেখানো হবে, এগুলো তোমার দরকার আছে! এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে সেও এক সময় অনুভব করবে, হ্যাঁ, এগুলো আমারও চাই!

কর্পোরেট বাণিজ্যের খপ্পরে পড়ে আমাদের কী দুরবস্থা, তা বর্তমান মূল্যবোধহীন সমাজ ব্যবস্থাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। নৈতিকতা, মূল্যবোধ এখন মূল্যহীন, যে কোনোভাবে টাকা কামাও, এটাই আজকের জীবন দর্শন।

তরুণদের শেখানো হচ্ছে হাই লাইফ, সেই হাই লাইফের কোনো সীমা নেই, তাই সর্বদাই আমরা উদ্ভ্রান্ত বুভুক্ষের মত ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। এক অলীক চাহিদার পেছনে আমরা ছুটছি। কোনো কিছুতে শান্তি নেই, তৃপ্তি নেই!

নৃবিজ্ঞানী সুসান র্যা ঙ্কল মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার আগে নির্বাচিত ২৬ জন প্রতিযোগির প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণাপত্রে তিনি বলেছেন, নির্বাচিত ২৬ জনকে যেভাবে ঘষেমেজে সম্ভাব্য মিস ইন্ডিয়া রূপে তৈরি করা হয় তাতে তার নিজস্ব স্বত্ত্বা বলে আর কিছুই বাকি থাকে না।

কেননা যে নির্বাচিত হবে সে তো শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়ে নয় ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিস ওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্সসহ ব্রান্ডিংয়ের কাজ করবে। তার ভাষায় এক্সপার্টদের বুজরুকিতে সুন্দরীদের ঘষামাজা করে এমন একজন আদর্শ তৈরি করা হয় যেমনটা পুঁজি দাবি করে। সুসান র্যা ঙ্কল এই প্রক্রিয়ায় শরীরকে তুলনা করেছেন একটি যন্ত্রের সঙ্গে।

যাকে যেমনটা শিখিয়ে দেয়া হবে ঠিক ততটাই সে করবে। এর মধ্যে আছে ডায়েট কন্ট্রোল, ভাষাভঙ্গি, ত্বক, ফ্যাশন ইত্যাদি। তবে কি সুন্দরীর সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তা তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম পন্থায়? অন্যের দ্বারা? তাই কি তারা বলছে, স্মার্ট হতে চাও, অমুক বিস্কুট খাও।

হাতে খোদাই করা লেখাটি বাসর রাতে স্বামীর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় স্ত্রী নিচ্ছে মিথ্যার আশ্রয়, বলছে চুইংগাম খেলে চাপার জোর বাড়ে, বাড়ে বিশ্বাসযোগ্যতা। আর এজন্য পরের ধাপে দেয়া হয় সবকিছুর বৈধতা। আর এ বৈধতা দানের শক্তিশালী মাধ্যমটির নাম মিডিয়া!

পুঁজিবাদের জগতে অন্যতম পণ্যের নাম নারী। নারীর শরীরকে পণ্য বানিয়ে পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে ব্যবসায়ীরা। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীকে মঞ্চে তুলে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়। নারীবাদীদের সমালোচনার থেকে বাঁচতে নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে।

ইদানীং সুন্দরী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘শারীরিক’ সৌন্দর্যের পাশাপাশি নারীর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, সাহস, চতুরতা, মানসিকতা, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদিও যোগ করে দেয়া হয়েছে। তারা বোঝাতে চায়, দেখো, আমরা শুধু ‘শরীর’নয়, মেধা বা মানসিক উৎকর্ষকেও গুরুত্ব দিই। ঠিক যেনো, নারী কোনও দোকানে থাকা পণ্য, ক্রেতা এসে পণ্যটিকে ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখে কিনে নেয়।

মাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্যাটাগরির ভিত্তিতে ও গুটিকয়েক লোকের পছন্দানুযায়ী নির্বাচিত কোনও এক নারীকে বিশ্বসুন্দরীর খেতাব দিয়ে পৃথিবীব্যাপী পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। জ্বলজ্বলে কামনার দৃষ্টি নিয়ে ঐ সুন্দরী নারীকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত হবে পুরুষেরা। তারা সুন্দরী সঙ্গীর বাসনায় স্বপ্নের ঘোরে বিশ্ব সুন্দরীর সঙ্গে কল্পনার রাজ্যে সময় কাটাবে।

ওদিকে পুরুষতন্ত্রের ইচ্ছে দিয়ে তৈরি এসব বিশ্বসুন্দরীর বিত্ত-বৈভব-পোশাক-অলঙ্কার দেখে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত কিশোরীরাও কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলবে! গণমাধ্যমে সুন্দরীর লাস্যময় ছবি দেখে কেবলেই ভাববে, ইস আমি যদি এমন হতে পারতাম!

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষেরা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য এ ধরনের সুন্দরীর সংজ্ঞা অন্যদের মাথায় গেঁথে দিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এক সুন্দরীর ছবি মনের আয়নায় পুরুষেরা আঁকে ও জীবন সঙ্গী বানানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উলটো, তাই অনেকে ওই জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সুখী হতে পারে না। কেননা তার মনে থাকে এক ছবি আর বাস্তবে আরেক।

এই হুজুগ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। গুটিকয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সুন্দরের সংজ্ঞা বানিয়ে কিছু নারীকে বিশ্বসুন্দরীর খেতাব দিয়ে মূলত আপামর নারীদের অপমান করছে। যাকে ইচ্ছে ‘মিস বাংলাদেশ’বানিয়ে সাধারণ নারীদের ছোট করার অধিকার কে দিয়েছে এই প্রতিযোগিতার আয়োজকদের?

প্রতিটি মানুষই প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর। একটি সুন্দরের সাথে আরেকটি সুন্দরের তুলনা মূলত একটি প্রাধান্য দেওয়া, অন্যটিকে হেয় করা। এটি একটি বর্ণবাদী ধারণা। এর মাধ্যমে নারীর সঙ্গে নারীর উঁচুনিচু ভেদ তৈরি হয়। ফলে অনেক সুবিধাবঞ্চিত নারীরা এ বিভেদ ও কৌশলী ধনতান্ত্রিক রেসিজমের শিকার হয়ে নিজেদেরকে ছোট মনে করতে শুরু করে ও তারা মানসিক ক্ষতির শিকার হয়।

যা নারীকে পণ্য বানায়, তেমন আয়োজনে আমরা কেন যাব, কেন?

শেয়ার করুন