চিকিৎসকের কাছে রোগীদের প্রত্যাশা

ঞ্যোহ্লা মং

অন্য অনেকের ন্যায়, বাসায় বসে থাকতে থাকতে শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধে ফেলেছে। স্বাভাবিক চলাফেলার অভাবে প্রত্যেকের জীবনে নানা ছন্দ-পতন ঘটেছে, এই লকডাউনে। এক মাস যেতে না যেতে, শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। শুরুতে পরিচিত ডাক্তার বন্ধুদের পরামর্শে সামাল দিতে চেস্টা করি। সামাল দিয়েও ফেলেছিলাম। স্বাভাবিক হাসি-খুশিতে দিন কাটাতে থাকি। পরে এক মাস হতে না হতে আবারও সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এবার সমস্যা এমনভাবে শুরু হয়েছে আর শেষ হতে চাইছিল না। পরিচিত ডাক্তার চেম্বারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, কোন ডাক্তারই আর প্র্যাকটিস করছেন না। কি করি-কি করি, উপায় না দেখে আবার আমার পরিচিত, আত্মীয়, বন্ধু ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে দিনগুলো পার করতে থাকি। এক কথায় টেষ্ট ম্যাচ খেলতে থাকি। যদি না-ও জিতি, ড্র যেন করতে পারি।

শরীর কখনো খারাপ, কখনো ভাল এভাবেই কাটলো এপ্রিল থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। একটানা চার মাসের অধিক বাড়িতে কাটিয়েছি। বাড়ির ভিতরে থাকতে থাকতে বাইরে বের হতেও অনেকটা সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। ঈদের পর থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিস পুরোদমে চলছে দেখে, সাহস নিয়ে আমিও বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। একজন অভিজ্ঞ মেডিসিনের প্রফেসরকে দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সাক্ষাতের জন্য সিরিয়াল সংগ্রহ করি।

গত মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) সাক্ষাতের জন্য সকাল থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ১১টার দিকে বাড়ি থেকে প্রথম বের হই। চোখে নিম্নমানের গ্লাস, মুখে ডাবল মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস আর সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে মাস্ক পরা রিকশাওয়ালা খুঁজে ডাক্তারের চেম্বারে যখন পৌচ্ছি, তখন প্রায় ১২টা। আরো আধ ঘন্টা অপেক্ষা শেষে আমার সিরিয়াল এলে সাহস নিয়ে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করি। রুমে ঢুকে দেখি, ডাক্তার মাস্ক পরে কাচের দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখে রোগীদের বসার জন্য দুটো চেয়ার বসিয়ে রেখেছেন। সালাম দিয়ে বসার অনুমতি নিয়ে বসি।

ডাক্তার আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, বললাম। বয়স জিজ্ঞেস করলেন, বললাম। তারপর জিজ্ঞেস করলেন কি সমস্যা? বললাম ‘স্যার আমি গত এপ্রিল মাস থেকে…. ।’ আমার কথা শেষ করতেও দিলেন না। থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি এপ্রিল মাসের সমস্যা সমাধান করতে পারবো না। এখন কি সমস্যা বলেন।’ আমি আবার বলতে শুরু করলাম ‘স্যার আমি অনেক দিন থেকে…।’ আবার থামিয়ে দিয়ে বললেন ‘আমি না বলেছি এখন কি সমস্যা বলেন, আবার পিছনে গেলেন কেন?’ তিনি আরো বললেন ‘বাংলা বুঝেন না? বাংলা বলতে না পারলে, লিখে নিয়ে আসেননি কেন?’
পরে বললাম ‘স্যার, আমার এখানে এখানে ব্যাথা আর এই সমস্যা।’ তিনি ওজন দেখে নিয়ে কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। নিচে গিয়ে ঔষধগুলো কিনবো কি কিনবো না ভাবতে ভাবতে কিনে ফেললাম। কিনতে গিয়ে ঔষধ বিক্রেতাকে বললাম ‘এই ডাক্তারের কাছে সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলাম। সমস্যার ওপরে, আমায় আরো সমস্যাই বাড়িয়ে দিলেন। মনটাই খারাপ করে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।’

আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাত পেতে কত সময়, অর্থ আর ধৈর্য পরীক্ষা দিয়েই তবে দেখা পাই, আর সেই দেখা যদি এমনই দেখা সাক্ষাত হবে, তবে আগামীতে এমন চিকিৎসকের সাক্ষাত না পাওয়াই ভাল।

ঔষধ বিক্রেতা কর্মী আমায় কাস্টমার কেয়ার-এ গিয়ে কথা বলতে বললেন। বললাম ‘সেখানে বলে কি হবে? ব্যক্তি মানুষের পেশা যদি পরিবর্তন না ঘটায়, কাস্টমার কেয়ার আর কি করবে?’

কোথায় যেন পড়েছিলাম, সকল দেশের ডাক্তারদেরকে নাকি কাজে যোগ দেয়ার আগে ওয়ার্ল্ড মেডিকেল এসোসিয়েশনের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী শপথ করতে হয়। যার প্রথম প্রতিজ্ঞা হচ্ছে ‘I SOLEMNLY  Pledge to dedicate my life to the service of humanity’ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিজ্ঞা হলো ‘I WILL NOT PERMIT consideration of age, disease or disability, creed, ethnic origin, gender, nationality, political affiliation, race, sexual orientation, social standing or any other factor to intervene between my duty and my patient’।

আমাদের দেশে চিকিৎসা/ঔষধ পেশার সাথে জড়িত সকলে ‘স্বর্গের’ সুবিধাদি ভোগ করেন। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রতি মিনিটে মিনিটে যে আয় করেন তার কোন হিসাবও দিতে হয় না। অন্যদিকে ঔষধ বিক্রেতাকেও কোনদিন কম দামে ঔষধ বিক্রি করতে হয় না। আমরা ঔষধ দোকানে গেলে কখনো দরদাম করি না বা করার সুযোগ থাকেনা। যা দাম বলেন, তাই সকলকে দিয়ে আসতে দেখা যায়।

মাস্ক পরা একজন রিকশাওয়ালা দেখে দরদাম করে ফিরতে ফিরতে মনে মনে বললাম ‘এই দেখা সাক্ষাত করার আয়োজন করতে গিয়ে আমার সময় অর্থ দুই গেলো। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’ আমার হয়তো আগামীতে আরো কিছু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সুযোগ হবে, কিন্তু যারা গ্রাম থেকে হাতে থাকা সম্বল বিক্রি করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়ার আশায় ঢাকায় আসেন, তাদের যদি এমন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাত ঘটে কি হতো? ঐ গ্রামীণ কৃষকের মনে যে আঘাত লাগতো তার ক্ষতি কিভাবে নির্ণয় করা যেতো? আর সেই কৃষকের ক্ষতি কে পুষিয়ে দিতো? এমন নয় ছয় ভাবতে ভাবতে রিকশাটি বাড়ির সামনে এসে পড়লে ২০টাকা বেশি দিয়ে নেমে পড়লাম। রিকশাওয়ালা ভুলে বেশি দিয়েছি কিনা ভেবে ২০ টাকা ফেরত দিতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘রেখে দেন।’ তারপর মনে মনে বললাম ‘ডাক্তার আমার রোগ কি, না শুনে যদি হাজার টাকা নিয়ে ফেলতে পারেন। আপনিতো শরীরের পানিকে ডিজেলে রূপান্তর করে উপার্জন করছেন। আপনি না হয় আজ ২০ টাকা বেশি নেন।’

ডাক্তার আর রোগীদের মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা দীর্ঘদিনের। আমার একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মংসানু চৌধুরীর ও একই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে বলে জানি। তিনি একবার রাঙ্গামাটির কোন এক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গিয়ে, হাতে থাকা রিপোর্টগুলো খুলে দেখাতে চাইলে নাকি অনেকটা ধমকের সুরে বলেছিলেন, ‘আমি কি পরীক্ষা করতে বলেছি? আমি কি রিপোর্ট দেখাতে বলেছি?’

প্রফেসরের সঙ্গে একদিন আলাপচারিতায় জেনেছি, ভারত বিভক্তির আগে চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালে নাকি একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক কাজ করতেন, নাম ডা: টাইসম্যান। যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন ওয়ার ফ্রন্টে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ডা: টাইসম্যান এর প্রশিক্ষণ নিয়ে পাহাড়ে অনেকে সেই সময়ে নাম কুড়িয়েছিলেন বলে জানা যায়। তিনি হাসপাতালের বারান্দায় বসে থেকে, পথচারিদের শরীরের গঠন দেখে, নাকি বলে দিতে পারতেন কার শরীরে কি রোগ বহন করছে। তিনি ছাত্রদেরকে তাঁর অনুমান যাচাই করতে, পথচারিদেরকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে পাঠাতেন এবং ছাত্ররা টাইসম্যানের গুণ দেখে নাকি অবাক হতেন।

অনেক বছর পর, আমিও কি টাইসম্যানের দেখা পেলাম কিনা তাও ভাবছি। এবং সেই সময়ে টাইসম্যান কি রোগীদেরকে ধমক দিতেন? রোগীদেরকে বলতে না দিয়ে নিজে বলতেন আর শুধু ঔষধ লিখে দিতেন কিনা তা জানা যায় না। তবে, আমার অনুমান হলো, টাইসম্যান হয়তো ধমক দিতেন না। ধমক যদি দিতেন, তিনি এখনো পাহাড়ের বয়স্কদের মুখে মুখে বেঁচে থাকতেন না।

অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে একবার গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম। আমাদের গাড়ির সামনে পিছনে থাকা অন্যান্য গাড়ির যাত্রীদের ব্যতি-ব্যস্ততা আমাকে এখনো মুগ্ধ করে। কয়েক মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি নরলুংগা হাসপাতালে নিয়ে যায়। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর কোন ধরনের ঔষধপত্র না দিয়ে ছেড়ে দেন। সারা শরীর ব্যাথা ছিল বলে, ঔষধ খুঁজেছিলাম তাও দেননি। বলা হয়েছিল ‘আপনার এমন কিছু হয়নি ঔষধ খেতে হবে।’ ২ সপ্তাহ পরও ব্যাথা না কমলে অন্য আরেকটি হাসপাতালে (ফ্লিন্ডার্স মেডিকেলে) গিয়েছিলাম। আমার হাতে থাকা সকল কাগজ পত্র দেখে বললেন ‘আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। আপনার সব ঠিক হয়ে যাবে।’ অবাক করার বিষয় হলো বড় ধরনের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হলেও বিনা ঔষধে ভাল হয়ে গিয়েছিল।

রোগীরা এক ধরনের অসহায়ত্ব থেকে হাসপাতালে কিংবা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। ডাক্তারদের একটু ভাল ব্যবহার রোগীদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। ভাল লাগার কাজ করে। একই সাথে ডাক্তারদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, এমনকি সারা জীবন মনে রাখার কাজ করে।

একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ২ থেকে ৫ মিনিটের যে আয়, দেশে একজন দিনমজুরকে কম করে হলেও দু’দিন খাটতে হয়। আমাদের দেশে অস্ট্রেলিয়ার সুবিধাদি হয়তো নেই। আমরা সকলে (ডাক্তার ও রোগীরা) দেশের বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। একটু ভালবাসা পেলে রোগীরা ডাক্তারদেরকে আজীবন মনে রাখতে জানে, এইটুকু জানি।


লেখক: উন্নয়নকর্মী, ইমেইল: nmong7@yahoo.com

শেয়ার করুন