ভারতের মণিপুর রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা: প্রবাসী সরকার গঠন

ভারতের মণিপুর রাজ্যেকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলেন প্রদেশটির রাজনৈতিক নেতারা। একই সাথে তারা প্রবাসী সরকারও গঠন করেছেন। মণিপুর রাজ্য কাউন্সিলের মুখ্যমন্ত্রী ইয়ামবেন বীরেন এবং বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নরেংবাম সমরজিৎ এই ঘোষণা দেন।

২৯ অক্টোবর, মঙ্গলবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে মনিপুর রাজ্যের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরা ও ভারতের গণমাধ্যম দি নিউজ এমন খবর প্রকাশ করেছে।

রাজ্য কাউন্সিলের মুখ্যমন্ত্রী ইয়ামবেন বীরেন এবং বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নরেংবাম সমরজিৎ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তারা মণিপুরের মহারাজা লিসেম্বা সানাজোবার পক্ষ থেকে প্রবাসী সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করছেন।’ 

তারা আরো বলেন, ‘প্রবাসী সরকার জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতি চাইবে।’

সংবাদ সম্মেলনে ২০১২ সালে ঘোষিত মণিপুরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উচ্চস্বরে পড়ার পরে তিনি লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আজ থেকে এখানে বিধিমোতাবেক প্রবাসী সরকার পরিচালনা করব এবং আমরা আশা করি জাতিসংঘের অনেক দেশ আমাদের স্বাধীনতা স্বীকৃতি প্রদান করবে।’

প্রায় ২৮ লক্ষ মানুষের বসবাস ভারতের এই অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য মণিপুরে যা তথাকথিত ‘সেভেন সিস্টার্স’ এর অন্তর্গত। মায়ানমারের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় এই অঞ্চলটি সশস্ত্র সংঘাত এবং অস্থিতিশীলতার জেরে পড়েছে। 

এই রাজ্যে শতাধিক বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে এবং তাদের দাবি ভারত থেকে রাজ্যটিকে আলাদা করা। এই রাজ্যে জাতিগত মিশ্রণ রয়েছে যার মাইটি, নাগা, কুকি এবং পাঙ্গাল। এই সম্প্রদায়গুলো তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক নীতি ও নিয়ম রক্ষা করে চলতে পছন্দ করে। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরব উপস্থিতির কারণে যা তারা করতে পারছে না। এছাড়াও কয়েক দশক ধরে সেনাবাহিনীর সহিংসতা তাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সমরজিৎ আরো বলেন, ‘ভারতে থাকাকালীন মণিপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ, ভারতে অবস্থান করলে মণিপুর রাজ্য কাউন্সিলের কাউন্সিলররা, ভারত সরকারের হাতে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বিচার বহির্ভূত হত্যার মুখোমুখি হতাম।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সেখানে স্বাধীন নই এবং আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ধ্বংস হতে চলেছে।’

জাতিসংঘের দৃষ্টি আর্কষন করে তিনি আরো বলেন, ‘জাতিসংঘের উচিত আমাদের কথা শোনা। আমরা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চাই মনিপুরের মানুষ, মনিপুরে মানুষেরই মতোই বাঁচতে চায়।’

তবে, এই বিষয়ে ভারতের হাই কমিশনের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি গণমাধ্যমকে কোন ধরনের মন্তব্য করেননি। 

প্রসঙ্গত, মণিপুর হচ্ছে বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের একটি রাজ্য। কিন্তু মনিপুর আগে ভারতের অংশ ছিল না। মনিপুরের ইতিহাস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত ছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য। ১৮৯১ সালে বৃটিশ উপনিবেশিকরা মণিপুর রাজ্য দখল করে নেয়। বৃটিশ শাসকদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে মণিপুরের জনগণ আন্দোলন গড়ে তোলে। মণিপুরের শ্রমজীবী নারীরা ১৯০৪ সালে যে আন্দোলন শুরু করেন তা ধারাবাহিকভাবে চলে। যার মধ্যে ছিল ইংরেজ বাহিনীতে জোরপূর্বক নিয়োগ, বাজার বয়কট, অস্বাভাবিক জলকর ধার্য, খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের, কৃষকদের থেকে কম দামে ধান কিনে মজুদদারী এবং মণিপুরের বাইরে চাল রপ্তানির বিরুদ্ধে আন্দোলন।

এরপর ১৯৪৭ সালে ১১ আগস্ট মহারাজা বোধ চন্দ্র আর ইংরেজ সরকারের গভর্ণর জেনারেল লুই মাউন্টব্যাটনের মধ্যে একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে মণিপুর রাজ্যকে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেয়া হয়। ১৫ আগস্ট মণিপুর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 

১৯৪৯ সালে ১৫ অক্টোবর মহারাজা বোধ চন্দ্রের সাথে ভারত সরকারের এক চুক্তির মাধ্যমে মণিপুর ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়। অনেকে দাবী করেন এই চুক্তিটি মহারাজাকে জোরপূর্বক রাজি করানো হয়েছিল। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান রচনাকালে মণিপুরকে তৃতীয় শ্রেণির অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭২ সালে মণিপুরকে ভারত সরকার পূর্ণ রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে পূর্ণ রাজ্যের স্বীকৃতি মিললেও জনগণের অসন্তোষ কমেনি। জাতিগত নীপিড়ন, বিদ্রোহীদের দমনের নামে সেনা নির্যাতন মনিপুরের জনগণকে মননে পরাধীন রেখেছে। ফলে বারবার বিভিন্ন সংগঠন-গোষ্ঠির ভেতর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামের ডাক উঠেছে মনিপুরে।

মূলত মণিপুরকে ভারতের অন্তর্ভুক্তিকে প্রথম থেকেই মেনে নেয়নি অনেকে। ফলে ধারাবাহিক ভাবেই স্বাধীনতার দাবী বিভিন্ন সংগ্রাম গড়ে ওঠে। একই সাথে একাধিক স্বশস্ত্র সংগ্রামী সংগঠনেরও জন্ম হয়।

শেয়ার করুন