পাহাড়ে চাংক্রান, সাংলান উৎসব নিয়ে কিছু ভাবনা

বান্দরবানে ২০০৫ সালে আয়োজিত বর্ষবরণ উৎসবের একাংশ।

১.
পাহাড়ে সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব কী নামে অভিহিত হবে? কেন ‘বৈসাবি’ বলা যাবে না, এই নিয়ে একটি বিতর্ক আজো বিদ্যমান। মিডিয়ার লোকজন ‘বৈসাবি’ নামে সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে অনেককে অসন্তুষ্ট হতে দেখা যায়। ‘বৈসাবি’ শব্দটি ব্যবহার হলে আরো কিছু জাতিগোষ্ঠীর উৎসবের নাম বাদ যায় বলে, অনেকে শব্দটি ব্যবহারে অনিহা প্রকাশ করে থাকেন। তবে মিডিয়াকর্মীদের কাছে শব্দটি বেশ জনপ্রিয়। ছোট একটি শব্দ ব্যবহার করে পাহাড়ের অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠীর উৎসবগুলোকে বুঝানো সহজ হয়। উৎসবটি প্রায় একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয় বলে কোন একটি জাতিগোষ্ঠীর উৎসবের নাম উল্লেখ করে করা হলে অন্য অনেককে বঞ্চিত করা হয়।

‘বৈসাবি’ শব্দটি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার ফলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আয়োজক কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে অনেকগুলো উৎসবের নাম ব্যবহার করতে হয়। ‘বৈসাবি’ দিয়ে সকল জাতিগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব না করলেও মিডিয়াকর্মী, কবি, লেখকদের জন্যও শব্দটি খুব উপযোগী ছিল। কারণ একজন মিডিয়াকর্মী উৎসব কভার করতে শিরোনামটিতে একসঙ্গে ছয়-সাতটি নামবাচক শব্দ ব্যবহার করতে পারেন না। তবে ‘বৈসাবি’ শব্দটি’র ব্যবহার কমে যাওয়ায়, বর্তমানে জনসংখ্যায় কম জাতিগোষ্ঠীদের উৎসবের নামকেও গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করছি, এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক।

নাম নিয়ে বিতর্ক সম্পর্কে জানাশোনা আছে, পাহাড়ে এমন লেখক, মিডিয়াকর্মীরা বর্তমানে এক-দুইটি মাত্র জাতিগোষ্ঠীর উৎসবের নাম উল্লেখ করে অনেকে সংবাদ পরিবেশন করছেন। এতে লক্ষ্যণীয় হলো ঘুরে ফিরে পাহাড়ের বড় জাতিগোষ্ঠীর উৎসবের নামই উচ্চারিত হচ্ছে বৈসু, সাংগ্রাইং কিংবা বিঝু।
২.
ছেলেবেলায় সাংগ্রাইংকে ঘিরে নতুন কাপড় পরা, ফুল সংগ্রহ করা, গ্রামের পশু-পাখিদের জন্য খাবার ছিটিয়ে দেয়া, বন্ধুদের নিয়ে আশপাশের গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, বিহারের বুদ্ধ মূর্তি, ঘন্টিগুলো নদীর ঘাটে নিয়ে পরিষ্কার করা, অর্থ সংকুলান হলে ফানুস উড়ানো ছিল তরুণ যুবকদের যত আনন্দ আয়োজন।

গত কয়েক বছরে ডিজিটাল তরুণদের হাত ধরে একটি নতুন ধারা, নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। বিঝু এলে এখন নতুন নতুন গানের ভিডিও রিলিজ হচ্ছে! সবকটি গান বিঝু, সাংগ্রাইং, বৈসু কিংবা প্রেম বিরহকে ঘিরেই। এই ধারায় মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা আর তঞ্চঙ্গ্যা তরুণেরা বেশ এগিয়ে। তরুণেরা গান বাজনায়, ভিডিও এডিটিং কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছে। তরুণেরা উৎসবে নিজেদের গান বাজাতে পারছে এটা আনন্দের।

অনেক তরুণ মাতৃভাষার গানের পাশাপাশি বাংলা গানেও ভালো করছে। বিভিন্ন গানের প্রতিযোগিতায় স্থান করে নিচ্ছে। অনেকে আরো একধাপ এগিয়ে হিন্দিতে গান করার চেষ্টা করছে। হ্যাঁ, সবই ভালো দিক। সীমানা ছাড়িয়ে নিজেদের আরো ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা বলেই মনে করি। পাশাপাশি এটাও লক্ষ্যণীয় যে, আমরা তরুণেরা যত আনন্দ নিয়ে মাতৃভাষায় গান করছি, আঞ্চলিক ও রাষ্ট্রীয় ভাষায় গান গেয়ে প্রতিযোগিতায় স্থান করে নিচ্ছি, ততটা অবহেলা করছি নিজের পাশের গ্রামের কোন জনগোষ্ঠীর গানকে। পাশের গ্রামের গানকে জনপ্রিয় করার চর্চা না থাকায়, একজন চাকমা শিল্পী শুধু চাকমাদের কাছে, মারমা শিল্পী মারমাদের কাছে প্রিয় মুখ হয়ে উঠছেন মাত্র। কদাচিৎ কোন মারমা শিল্পী চাকমা গান গাইলেও একজন ত্রিপুরা শিল্পীকে মনের ভালোবাসা ঢেলে একটি মারমা গান গাইতে দেখা যায় না। একজন বম শিল্পী ইংরেজি গান গাওয়ার চেষ্টা করলেও তাকে ম্রো ভাষায় গান গাওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায় না।
পাহাড়ে সব জাতিগোষ্ঠীর উৎসবকে এক কাতারে তুলে ধরার চেষ্টা থাকলেও শিল্পীদের মাঝে কিন্তু সে তাগিদ লক্ষ্য করা যায় না। শিল্পীদের এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন- খুব কঠিন, গানগুলো সঠিকভাবে আসে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অপরদিকে, বান্দরবানের একজন মুদির দোকানদার নিজে ম্রো ভাষা শিখে ম্রোদের কাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে পারলেও কোনো খিয়াং শিল্পী কিন্তু ম্রো ভাষায় প্রাথমিক যোগাযোগের দুই-একটি শব্দও শেখার আগ্রহ দেখান না। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। গুইমারার ছেলে জয়বর্ধন চাকমা, যিনি মারমা গান গেয়ে দেখিয়েছেন যে তিনি মারমা ভাষাও মাতৃভাষার মত বলতে পারেন। তেমনি আরো একজন বাঙালী নারী শিল্পী চৈতী মুৎসুদ্দিও চমৎকারভাবে মারমা গান গাইছেন। কিন্তু একজন ত্রিপুরা শিল্পীকে মারমা গান গাইতে বলা হলে নানান অজুহাত সামনে এসে দাঁড়ায়! এদিকটি বিবেচনা করলে চৈতী মুৎসুদ্দি আমাদের ধন্যবাদের প্রাপ্য। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন আগ্রহ, ভালোবাসা আর যত্ন থাকলে সবই সম্ভব।

৩.
অন্য সকলের ন্যায় উৎসবকে ঘিরে নতুন পোশাক কেনার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। চাকমা সমাজে নারীদের পিনন-খাদিকে নতুনত্ব আর আধুনিক করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। পাহাড়ে প্রতি হাটবারের দিন গ্রামীণ নারীরাও ভাসমান দোকান বসিয়ে পিনন-খাদি বিক্রি করতে দেখা যায়। পিনন-খাদির সুতার দামের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে দাম বেশি হওয়ায় বর্তমানে গ্রামীণ সাধারণ নারীদের জন্য এ ব্যবসাও একপ্রকার কঠিন হয়ে ওঠেছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে শহরের কিছু তাঁতীরা। তারা পাহাড়ের পিনন এর ডিজাইনের সাথে যৎসামান্য মিল রেখে কম দামে পাহাড়ের দোকানগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ে প্রায় প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রিক দোকানগুলোতে এমন পোশাকের বিকিকিনির দেখা মেলে। পর্যটকেরাও পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী পোষাক মনে করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সময়ে বাজারে গেলে পিনন-খাদি দেখে বলে দিতে পারতাম, কে কোন জাতিগোষ্ঠীর। বর্তমানে খুব কম দামে বিকৃত ও নিম্নমানের পিননে বাজার সয়লাব হওয়ায় এবং সহজলভ্যতার কারণে প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীর নারীরা ঘরে-বাইরে সেগুলো ব্যবহার করে থাকেন। পাহাড়ের বুনন শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যবাহী পোশাকের আধুনিকতার পাশাপাশি সহজলভ্য করে দিতে না পারলে খুব দ্রুত হারিয়ে যাবে।

নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিজেদের দ্বারা হতে হবে কেন? যেখানে উৎপাদিত হোক না কেন সেগুলো যাতে যথাযথভাবে নকশা অনুসরণ করে বাজারজাত করা হয় সেদিকটি লক্ষ্য রাখা জরুরি। এজন্য তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ নিয়ে ভূমিকা রাখতে হবে।

এক সময় সরকারি তাঁত শিল্প নকশাগুলো অনুসরণ করে বুনন কাজটি করলেও অজানা কারণে সে সব প্রতিষ্ঠানগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। এছাড়াও রাঙ্গামাটিতে বেইন টেক্সটাইলের উদ্যোক্তা নিজেই সমাজের একজন তারকা বনে গিয়েছিলেন। এখন সেই বেইন টেক্সটাইলের দোকানগুলোও আর চোখে পড়েনা।

বর্তমানে শুধু কিছু সংখ্যক ডিজাইনারদের দ্বারা চাকমাদের পোশাকের আধুনিকায়নের কাজ হতে দেখা যায়, যা সাধারণ নারীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে বলেই জানি। অন্যদিকে, মারমা নারীরাও ঐতিহ্যবাহী পোশাক বলে বাজার থেকে দামিদামি কাপড় ক্রয় করে পরিধান করে থাকেন। সাংগ্রাইং এলে পোষাকের দাম ২০-৩০ হাজার পর্যন্ত ওঠে বলেও শোনা যায়। তরুণেরা মারমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তবে কেউ যদি কোনো মারমা তরুণকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনাদের পোষাক কোথায় তৈরী হয়?” তিনি উত্তরে কি বলবেন? এটা তো সত্যি, আমরা যে পোষাক পরি সেটা কোথায় তৈরি হয়, কারা তৈরি করেন তার কিছুই জানা নেই। সেই তাঁতীদের/শিল্প মালিকদের সঙ্গে আমাদের কোন যোগাযোগও নেই। মারমারা যে কাপড় পরেন তা আসে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, কম্বোডিয়া কিংবা থাইল্যান্ড থেকে। ফ্যাক্টরী সেখানে থাকতেই পারে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু কাপড়াটা আমাদের হতে হলে, কাপড় তৈরিতে আমাদের কোন না কোন ধারণা, চিন্তা থাকা আবশ্যক বলে মনে করি।

আমাদের দেশে সারা বিশ্বের কাপড় তৈরি হয়। তারা শুধু কিনে নিয়ে যায় না, কাপড়ের মান, রং, ডিজাইন, সেলাই কেমন হবে সবই তারা ঠিক করে দেন। কাপড় তৈরিতে তাদের চিন্তার প্রতিফলন থাকে। আর আমরা মারমারা যেসব কাপড় নিয়ে গর্ব করি, সে সব কাপড় তৈরিতে আমাদের কোন চিন্তা, দর্শন আছে কি? বর্তমানে পিনন খাদি সংকটের সুযোগে সমতলের একদল তাঁত ব্যবসায়ী নিজেদের মতো করে আমাদের জন্য তৈরি করে বাজার ভরে তুলছেন। আমাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, জ্ঞান রক্ষার্থে সে সব তাঁত ব্যবসায়ীদের সাথে আশু আলোচনা হওয়া জরুরি।

৪.
আবার ভাতজোড়া ফুল বা বিঝু ফুল এলে আমরা বুঝতে পারি আমাদের বিঝু উৎসব আর খুব বেশি দূরে নয়। ফুল বিঝুর দিনে এ ফুলের চাহিদাও বেশ। মারমাদের কাছে ‘সাংগ্রাইং পাঁই’, ‘ক্রাসওয়ং পাঁই’, ত্রিপুরাদের কাছে ‘খুঁ রেংক’ু, ‘তক মকাই’, ‘খুম মাইরুং তৈ’ নামে ফুলটি অতি পরিচিত ও জনপ্রিয়। ফুলটি বছরে একবারই ফুটে।

ফুলটির সাথে বৈসু, সাংগ্রাইং আর বিঝু’র সম্পর্কিত হলেও কোন পাহাড়ি পরিবারে এই ফুল গাছটি লাগিয়ে রাখা হয় না। বন জঙ্গলে অবহেলায় পাওয়া যায় বলে, ফুলটিকে কেউ যত্ন নেয়না। বর্তমানে চারদিকে পাহাড়গুলো নেড়া হয়ে ওঠেছে। প্রাকৃতিক বনও তেমন অবশিষ্ট নেই। ফলে দ্রুত গতিতে ফুলটিও আমাদের আড়ালে চলে যেতে শুরু করেছে।

আমরা কত কিছুর যত্ন নেয়ার কথা বলি। সাংগ্রাইং এলে নতুন কাপড়, নানা রঙের খাবার তৈরির প্রতিযোগিতা করি। কিন্তু নিরবে এই বিঝু ফুলটি যে হারিয়ে যাচ্ছে তা কতজনে খেয়াল রাখছি? আগে যেখানে সেখানে ফুলটি পাওয়া গেলেও এখন ফুলটি পেতে রীতিমতো খুঁজতে বের হতে হয়। আমরা কত কত ফুলের বাগান করি। নানা প্রজাতির ভিড়ে বিঝু ফুলটি স্থান পায়না। বিঝু পরিবেশনে যেমন শহরের দামি খাবার, বিদেশি আইটেমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, একইভাবে ফুলগুলোতেও বিদেশি ফুলগুলো দেশীয়, স্থানীয় ফুলের বিকল্প হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে।
সামাজিক উৎসবে আমরা যত না আনন্দ করতে আয়োজন করি, ততটা অযত্ন অবহেলায় আমরা আমাদের বড় সাংস্কৃতিক উৎসবের উপাদানগুলোকে হারিয়ে ফেলছি। উৎসব সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলোকে যত্ন নিতে ভুল করলে এক সময় উৎসবটি হয়তো হারিয়ে যাবেনা, তবে বিকৃত হতে বাধ্য। উৎসবকে ঘিরে আনন্দ করার পাশাপাশি আমাদের সাংস্কৃতিক নানা উপাদানগুলোকে সংরক্ষণের পাশাপাশি গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি।

সকলকে সাংগ্রাইং, বিষু, বৈসু, বিহু, বিঝু, সাংলান, সাংক্রাই, চাংক্রান শুভেচ্ছা।

শেয়ার করুন