“খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভেতরে”- কবিগুরুর কথার সাথে তাল মিলিয়েই যেন খেলাঘর বাঁধায় মন প্রাণ উজাড় করে দিচ্ছেন আনিকা। তবে কবিগুরু যে খেলাঘরের কথা বলছেন, এ ঘর সেটি নয়। সত্যি সত্যি শিশুদের জন্য খেলাঘর নিয়ে মেতে উঠেছেন আর্টজেনিক্স বাই আনিকা’র উদ্যোক্তা আনিকা নূর।
একটা ছোট্ট পুতুলের ঘরের শখ কার না থাকে! আনিকারও ছিল। আর তাইতো শোকেসের এক কোণ ছেড়ে দিলেন মা। সেখানেই আনিকা বিস্তৃত করলেন তার রাজ্য। “কতভাবেই না সাজাতাম আমার ঘর। শোকেসের কিংবা শেলফের ঐ অংশটুকু ছিল আমার রাজত্ব। একেকদিন একেকভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতাম আমার পুতুলের ঘর।” বলছিলেন আনিকা।
ঘর বানানো আর সাজানোর প্রতি এই আগ্রহ দেখে ছোটবেলার এক শিক্ষক বলেছিলেন আনিকা স্থপতি হবে। তাই সত্যি হলো। স্থাপত্যবিদ্যায় পড়ালেখা করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিকাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয় যে তিনি কেন এ বিষয়ে পড়তে চান? তার উত্তর ছিল, “একটা অনেক বড় পুতুলের ঘর বানাতে চাই বলে!” উত্তরটা কৌতুক করে দিলেও আনিকার কিন্তু সত্যি সত্যিই সেই ছোটবেলার না পাওয়া পুতুলের খেলাঘর বানাবার শখটা মনের গোপন কুঠুরিতে জমা ছিল।
এরপর কেটে গেল বেশ কিছু সময়। স্থপতি আনিকা নূর এরপর মন দিলেন ক্যারিয়ারে। এর মাঝে সন্তান এলো। বেশ কয়েক বছর টানা স্থপতি হিসেবে কাজ করার পর জীবনের তাগিদে সন্তানের দিকে মন দিতে হলো আনিকাকে। করলেন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি, ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং-এর প্রফেশনাল কোর্স। সন্তানের একমাত্র কেয়ারগিভার হিসেবে দক্ষতা বাড়াতে করলেন শিশুর বিকাশ সম্বন্ধীয় কোর্সও। এর মাঝেই হানা দিলো মহামারি। কাজকর্ম গুটিয়ে এলো। তখন সন্তানের স্ক্রিনটাইম কমানোর প্রয়াস থেকে তিনি নানারকম খেলার ম্যাটেরিয়াল বানানো শুরু করলেন।
“শুরুটা করেছিলাম ঘরে থাকা এসির বাক্স, নষ্ট সিডি, বোতলের ছিপি ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে। নিজের ছেলের জন্য কিচেন সেট বানালাম। তারপর থেকে ঘরে থাকা বাড়তি জিনিসপত্র দিয়ে নানারকম খেলার জিনিসপত্র যেমন পেপা পিগ হাউস, রেসিং কার ট্র্যাক ইত্যাদি বানাতে লাগলাম। সেসব ছবি নিজের ফেসবুকে শেয়ার করতাম। সেই ছবিগুলো দেখেই আমার এক কাজিন আমাকে প্রথম অর্ডার দিলো তার মেয়ের ডলস হাউস বানিয়ে দেয়ার জন্য। প্লাস্টিক উড দিয়ে বানিয়েও ফেললাম ছোট্ট একটা পুতুলের বাড়ি। দেয়াশলাইয়ের বক্স দিয়ে ছোট ছোট আসবাব বানিয়ে সেই বাড়ি সাজিয়েও দিলাম। কাজটা সবাই খুব পছন্দ করলো। এরপর একটা পেইজ খুলে সেখানে পোস্ট দিলাম। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দুটো অর্ডার পেয়ে গেলাম। মাত্র ১০০০ টাকা মূলধন আর ভাইয়ের দেয়া একটা প্রিন্টার নিয়ে ২০২০ সালের নভেম্বরে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আর্টজেনিক্স বাই আনিকা’র যাত্রা শুরু করেছিলাম। আর্টজেনিক্স (Artgenics) মানে made with passion and love. আমার প্রত্যেকটা কাজই সবটুকু ভালবাসা আর মমতা ঢেলে দিয়েই করার চেষ্টা করি”-বললেন আনিকা।
আপনার গ্রাহক মূলত কারা? এর উত্তরে আনিকার হাসিমাখা বক্তব্য- “ আমার ক্লায়েন্ট কিন্তু পাঁচ থেকে বার-তের বছরের শিশুরা। ওদের স্বপ্নরাজ্যের খুঁটিনাটি গড়ে তোলার দায়িত্ব যেহেতু আমার কাঁধে তারা দিয়ে দেয়, তাই চেষ্টা করি ওদের চাহিদা আর পছন্দমত সব করে দিতে। ওরা কোন ঘরে কী চায়, কেমন ডিজাইন চায় তা নিয়ে আমি প্রথমে ওদের সাথেই মিটিং করি! আর এসব করতে গিয়ে কত কত ক্যারেক্টার আর বিষয় নিয়ে যে আমাকে পড়ালেখা করতে হয়!”
এখন পর্যন্ত আনিকা একেবারে একা হাতেই সামলাচ্ছেন নিজের উদ্যোগ। তবে দু’জন কোলাবোরেটর আছেন যাদের কাছ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী মিনি ফিগার এবং মিনিয়েচার সরন্জাম নিয়ে থাকেন আনিকা। কোভিডের সময় সব কাঁচামাল অনলাইনে কিনতে হয়েছে বলে দাম বেশি পড়লেও অনলাইনের শক্তিকে তিনি সাধুবাদ জানাতে চান। কেননা আনিকার ব্যবসার পুরোটা সময়ই তিনি অর্ডার পাওয়া থেকে শুরু করে, কাঁচামাল কেনা, ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং, সমন্বয় কিংবা নিজের পণ্যের মার্কেটিং পর্যন্ত সবকিছুই অনলাইনে করতে পেরেছেন। এর ফলে নিজের সন্তানকেও সময় দিতে পেরেছেন আবার কাজও করতে পেরেছেন। প্যাশনের সাথে সাথে নিজের জীবন ও জীবিকার তাগিদ যে কাজ থেকে মিটছে সে কাজের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়।
আনিকার উদ্যোগের গ্রাহক মূলতঃ শিশু। শিশুদের হাতে যেকোন কিছু তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্ব অনেক বেশি বলে মনে করেন তিনি। খেলনা বা বাড়ি বানানোর সময় ছোট ছোট সরন্জাম দিয়ে যেন চোকিং হ্যাজার্ড না হয়, কিংবা যে উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে তা যেন বিষাক্ত না হয়, অথবা শিশুরা খেলার সময় পানি বা তরল কিছু লাগলে যেন তা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এসব দিকেও খেয়াল রাখতে হয় আনিকাকে। নিজের সন্তানের জন্য তিনি যা ব্যবহার করেন, তা তিনি অন্য সন্তানের জন্যও নিশ্চিত করেন। আর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছেন, পাঁচ বছরের আগে শিশুরা ডলস হাউস বা এই জাতীয় খেলনা সঠিকভাবে খেলতে পারেনা অথবা খেললে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। আর তাইতো আনিকা পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের জন্য খেলনা সরবরাহ করেননা।
একা হাতে কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যবসায় কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। অর্ডার পেলেও আনিকা মাসে বেশি কাজ হাতে নিতে পারেননা। কিছু ক্ষেত্রে ডেলিভারি দিতে দেরীও হয়ে যায়। এছাড়াও গ্রাহককে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার সুবিধাও যোগ করতে পারেননি এখনো পণ্যের আকার ও জনবলের স্বল্পতার অভাবে।
সেই ছোট থেকে লালন করা স্বপ্নের পুতুলের ঘরটি বানানোর যে ছোট্ট স্বপ্ন, তা নিয়ে আনিকার পরিকল্পনা অনেক। আরো উন্নত ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে, প্রয়োজনীয় মেশিন ব্যবহার করে আরো টেকসই করে শিশুদের স্বপ্নের বাড়িগুলো তিনি বানাতে চান। উৎপাদনশিল্পের কাতারে নিয়ে যেতে চান তার এই উদ্যোগকে। ঘরে থাকা জিনিসপত্র দিয়ে শিশুরা যেন নিজেরাও তাদের খেলার সরন্জাম নিজেরা বানাতে পারে, রিসাইক্লিং শিখতে পারে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চান। আনন্দময় শৈশবের জন্য অনেক অনেক দামী জিনিসপত্রের যে দরকার নেই, পুঁজিবাদী বাজারের অহেতুক মোহ থেকে সেই নির্মল শৈশবকে আলাদা করার তাগিদ অনুভব করেন আনিকা। শিশুরা অতকিছু চায়না। ওরা চায় নিজেদের একান্ত একটা জায়গা। একটা স্পেস। যেখানে নিজেরা একেকজন রাজা। তাদের স্বপ্নরাজ্যের একেকজন প্রতিষ্ঠাতা। সেই স্বপ্নরাজ্যের সারথী হয়ে আনিকা নূর তার উদ্যোগকে বহুদূর এগিয়ে নিতে চান।
পেইজ লিংক: আর্টজেনিক্স বাই আনিকা