রোজায় কী করবেন, কী করবেন না

Photo: Khaleej Times

রোজা-রমজান মানুষের নফস্ রিপুকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, তাই এ মাসকে রমজান মাস বলে। রমজান শব্দের অর্থ হল পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া। এ মাস আত্মশুদ্ধির মাস। দুনিয়ার রাজা বাদশাগণ তাদের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়, আনুগত্য আর আত্মত্যাগের। মুসলমানগণ আল্লাহর বাহিনী। আল্লাহ বলেন, “তারা হল আল্লাহর বাহিনী।” তাই আল্লাহ তার বাহিনীকে আত্মশুদ্ধি, আত্মত্যাগ এবং আত্মগঠনের প্রশিক্ষণ দেন।

এ মাস হল প্রশিক্ষণের মাস। সিয়াম সাধনার মাস। এর মাধ্যমে আত্মগঠন, চরিত্রগঠনের সাথে সাথে ত্যাগী ও সংযমী হওয়া যায়। তাকওয়ার গুণ অর্জন করে সঠিক ভাবে সামাজিক ও ঈমানী দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারেরা তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হল, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পার। আল-কোরআন।

এই তাকওয়া অর্জন করাটাই হল রোজা রমজানের মূল কথা। তাকওয়া মানে গোপনে এবং প্রকাশ্যে আল্লাহর ভয় ভালবাসা অন্তরে নিয়ে জীবন যাপন ও দায়িত্ব পালন। রোজা রমজান পালন করে যদি তাকওয়া লাভ করতে না পারে তার সিয়াম সাধনাই অসার।

আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, যে রোজা রমজান পালন করে মিথ্যা কথা ও কাজ ছাড়তে পারল না, তার উপোস থাকায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। আল-হাদীস। নাউযুবিল্লাহ। তাকওয়া মানে বেচে থাকা। গুণাহ বা পাপ থেকে, ভেজাল দুর্নীতি থেকে, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ থেকে, সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া থেকে, নারী নির্যাতন ও জুলুম অত্যাচার থেকে, আল্লাহ বিরোধী আইন ও শাসন, রাজনীতি ও শিক্ষানীতি থেকে বিরত থেকে, আল্লাহ রছুলের (সাঃ) সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলাই হল তাকওয়ার দাবী। যারা বিরত থাকবে তারাই লাভ করতে পারবে তাকওয়ার ফজিলত। ফাজায়েল অর্থ ফজিলত সমূহ। মাছায়েল মানে নিয়ম কানুন, যা নি¤েœ বর্ণনা করা হল।

তাকওয়ার ফজিলত:
যারা তাকওয়া অর্জন করবে আল্লাহ তাদেরকে ফোরকান দান করবেন। ভাল মন্দ মঙ্গল অমঙ্গল চিহ্নিত করার এবং সঠিক বেঠিক নির্ধারণের যোগ্যতা দান করবেন। আল-কোরআন। যারা তাকওয়া অর্জন করবে আল্লাহ তাদের কাজ সহজ করে দিবেন। আল-কোরআন। যারা তাকওয়া অর্জন করবে আল্লাহ এমন ভাবে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করবেন তারা বুঝতেই পারবে না যে, কোন দিক থেকে কি হয়ে গেল। কি ভাবে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কোন বিপদ হলে বিপদ কাটিয়ে উঠার ব্যবস্থা করে দেবেন আল্লাহ। আল-কোরআন।

ঈমান আর তাকওয়া কাক্সিক্ষত মানের হলে সেখানে অশান্তি থাকে না। অভাব থাকে না। ইসলামের পঞ্চম খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জামানায় জাকাত দেয়ার লোক পাওয়া যেত চারিদিকে, জাকাত নেয়ার লোক পাওয়া ছিল দুস্কর। ইহাই ছিল তাকওয়ার ফল। একদিন ইয়েমেন থেকে নওমুসলিমের একটি ১০/১২ জনের দল মদীনায় আসলেন, তাদের সাথে রসদ তেমন নেই। তারা খাদ্য পাওয়ার আশায় একজন দূতকে প্রিয় নবীর কাছে পাঠালেন। তিনি এসে ঘরের ভিতর থেকে প্রিয় রাছুলকে তেলাওয়াত করতে শুনলেন যে ‘‘এমন কোন প্রাণী নেই যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ নেননি”। আল-কোরআন। এই কথা শুনে তিনি ভাবলেন আল্লাহকে রিজিকের মালিক বিশ্বাস করে অন্যের কাছে কি ভাবে রিজিক চাইব? তিনি প্রিয় নবীকে (সাঃ) খানার কথা না বলে চলে গেলেও আল্লাহ কিন্তু তাদের খানার ব্যবস্থা ঠিকই করে দিয়েছিলেন। ইহাই হল ঈমান ও তাকওয়ার ফল বা ফজিলাত।

রমজানের ফজিলত:
এই রমজান মাসেই মানুষের হেদায়েতের জন্য সত্য মিথ্যার মাপকাঠি হিসাবে আল্লাহ কোরআন নাজিল করেছেন। আল কোরআন। আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, রমজানে যে একটি ভাল কাজ করল সে অন্য মাসের ফরজের সমান, যে একটি ফরজ আমল করবে সে অন্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান সওয়াব পাবে। এ মাসে একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চাইতে উত্তম। আলহাদীস। যে ঈমানদারির সাথে হিসাব করে করে রোজা রাখবে এবং রাতে এবাদত করবে আল্লাহ তার আগের গুনা গুলো ক্ষমা করে দিবেন। আলহাদীস।

ঢাল যেমন মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করে রোজাও তেমন মানুষকে গুণা পাপ থেকে বাচায়। আলহাদীস। এই রোজা কেয়ামতের দিন বান্দার মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে। আল্লাহ তার সুপারিশ কবুল করে বান্দাকে মাফ করে দিবেন। আলহাদীস। ঈমানদার বান্দারা তার সম্পদ, পরিবার এবং প্রতিবেশীর ব্যপারে যা ভুল করে, রোজা তার কাফফারা হয়ে যায়। আলহাদীস। এই রমজান মাসে জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শিকল পড়িয়ে বন্ধী করে রাখা হয়। কোন মুমীন মুসলমান মারা গেলে তার কবর আজাব মাফ করে দেয়া হয়। কেউ অতিরিক্ত খানা পিনা করলেও তাকে জবাবদিহি করতে হয় না।

এই মাসে যারা রোজা রাখবে তাদেরকে আল্লাহ নিজ হাতে পুরস্কার দিয়ে ধন্য করবেন। শবে কদরও তারা লাভ করতে সক্ষম হবেন। রোজা দারের মুখের গন্ধ মেশক আম্বরের খুশবুর মত হবে। তাই রোজাদারদের উচিত রোজা রাখার সাথে সাথে কোরআন জেনে বুঝে পড়ে কোরআন অনুযায়ী জীবন গড়া ও দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া।

ফজিলাত থেকে যারা বঞ্চিত হবে:
রোজা রমজান এবং তাকওয়া ফজিলত এত বেশী হওয়া সত্ত্বেও কিছু দূর্ভাগা মানুষ এই সব ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবে। নাউযুবিল্লাহ। তাদের মধ্যে ১নং হলো যারা আল্লাহর সাথে শিরিক করে। শিরিক হল কথা, কাজে বিশ্বাসে, স্বত্তা ও গুনাবলীতে, ক্ষমতা এবং অধিকারে কোন ব্যক্তি, বস্তু, শক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আল্লাহর সমান করা। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাথে শিরিক করাকে ক্ষমা করবে না। আল-কোরআন। সুরা নিসা।

২নং হলো যারা কোরআনের কিছু মানে কিছু মানে না। আল্লাহ বলেন, মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে যারা বলে আমরা আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছি। তারা কিন্তু ঈমানদার নয়। আল-কোরআন। সুরা বাকারা।

৩নং হলো যারা হারাম উপার্জনকারী। আল্লাহর নবী বলেন, একজন লোক তার গায়ে ধুলি বালি, অনেক দূর থেকে খানায় কাবায় এসে দোয়া করছে, তার দোয়া কি ভাবে কবুল হবে? তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরনে হারাম। আলহাদীস।

৪নং হলো আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা এবং মিথ্যা কাজ, মানে পাপ ছাড়তে পারল না, সে খানা পিনা বন্ধ রাখায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। কিছু রোজাদার আর রাত জাগার লোক আছে, যারা রোজা রেখে রাত জেগে উপোস থাকা আর রাত জাগা ছাড়া কিছু পায়না। আলহাদীস।

যারা রোজা রমজান ও তাকওয়ার ফজিলত লাভ করতে চায়, তাদের উচিত শিরিক ত্যাগ করে পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়া এবং কোরআনের ধর্মীয় রাজনৈতিক, অর্থ-নৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক সকল বিধি বিধানকে বিশ্বাস, গ্রহণ ও মান্য করে চলা।

  • রোজার মাছায়েল:
  • প্রাপ্ত বয়স্ক সকল নারী, পুরুষের উপর রোজা রাখা ফরজ। রোজা যারা রাখতে চান তাদেরকে রাতে, ভোর রাতে অথবা সকালে রোজার নিয়ত করতে হবে। মনে মনে নিয়ত করলেও রোজা হবে।
  • রোজা রাখার জন্য সেহরী খেতে হয়। সুবহে সাদেক শুরু হওয়ার আগে আগে সেহরী খাওয়া বন্ধ করতে হবে। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ, পানীয় পান এবং স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকার নাম রোজা।
  • এই রোজা রেখে ভুলে যদি কেউ কিছু খেয়ে ফেলে রোজা হয়ে যাবে। তবে মনে হওয়ার সাথে সাথে এক দানাও আর খেতে পারবে না। মূখ পরিস্কার করে ফেলবে।
  • কেউ যদি ইচ্ছা করে কিছু খায় সাথে সাথে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে। তাকে একটি রোজার পরিবর্তে ৬০টি রোজা রেখে রোজা ভাঙ্গার কাফ্ফারা দিতে হবে। কারণ এই রোজা ভাঙ্গা মস্তবড় পাপ।
  • ইফতারের আগে দরুদ পড়ে দোয়া মুনাজাত করবে, এই সময় দোয়া কবুল হয়। ইফতার করতে করতে জামাত যেন চলে না যায় খেয়াল রাখতে হবে।
  • খোরমা খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করবে অথবা পানি খেয়ে।
  • কেউ যদি অনিচ্ছায় কিছু খেয়ে ফেলে, যেমন অজু করার সময় পানি খেয়ে ফেললে অথবা জোর করে কেউ কিছু খাইয়ে দিলে তখন রোজা ভেঙ্গে যাবে ঠিক, তবে তাঁকে সারা দিন রোজাদারের মত কিছু না খেয়ে থাকতে হবে। যদি খেয়ে ফেলে তা হলে সে ইচ্ছা করেই রোজা রাখে নি বুঝা যাবে। নাউযুবিল্লাহ।
  • রোজা রেখে নেহায়েত প্রয়োজন হলে যে সব ইনজেকশন শক্তি ও খাদ্যের বিকল্প নয় তা গ্রহণ করা যাবে। তবে না করা ভাল।
  • রোজা রেখে কোন মূমূর্ষ ব্যক্তির জান বাচানোর জন্য রক্ত দেয়া যাবে, যদি বিকল্প না থাকে। রোজা রেখে ঝগড়া ঝাটি, তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হওয়া না জায়েজ।
  • রোজা রেখে ধোঁয়া গ্রহণ, তরকারীর স্বাদ গ্রহণ না জায়েজ। তবে কোন মহিলা ক্ষতির আশংকা থাকলে তরকারীর লবণ দেখে, থুথু করে ফেলে দিবে। গিলে নিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
  • রোজা রেখে গোসল ফরজ হলেও গড়গড়াসহ কুলি করা যাবে না।
  • রোজা রেখে কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ পাঠ, তসবিহ পাঠ এগুলোই হল নেক আমল। এ মাসে ফকির মিসকিনকে দান করলে, অন্য-মাসের চাইতে ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত সওয়াব বেশি পাবে। তাই এই মাসকে সহানুভূতির মাস বলা হয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। আমীন।

আলাউদ্দিন ইমামী, খতীব, বান্দরবান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।

শেয়ার করুন