প্যারাসেইলিং
দশ মিনিটের পাখি জীবন

ছোটবেলায় আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে আপনার কি কখনো ইচ্ছা হয়েছে ঘুড়ির সাথে উড়ে যেতে বা গ্যাস বেলুনের উড়ে যাওয়া দেখে ভাবতে বসেছেন কেমন হয় অজস্র গ্যাস বেলুন একসাথে সুতো দিয়ে বেধে তার সাথে উড়ে গেলে?

মানুষের যেখানে সীমাবদ্ধতা, সেখানেই আগ্রহ চূড়ান্ত রকম বেশি। তাই ডানাবিহীন হয়ে জন্মানোর দুঃখ ঘোচাতে উড়াউড়ির প্রচেষ্টা শুরু অনেক আগে থেকেই। আকাশে ওড়ার কত রকম সরঞ্জামই না মানুষ আবিষ্কার করেছে, আদ্যিকালের বেলুন থেকে শুরু করে হালের বিমান পর্যন্ত। পাখির চোখে পৃথিবী দেখার এক দুরন্ত ইচ্ছা মানুষ পুষে রাখে নিজের ভিতরে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বাইরের দেশগুলোর সমুদ্রতট গুলোতে ওয়াটার স্পোর্টস দেখতে দেখতে ভাবতাম, আমাদের দেশে এত বিশাল একটা সমুদ্রতট থাকতেও তেমন কোন ওয়াটার স্পোর্টসই নেই। তাই কক্সবাজারে প্যারাসেইলিং জাতীয় খবর যখন থেকে সোশ্যাল মিডিয়া আর গনমাধ্যম গুলোতে দেখতে শুরু করলাম, বাকেট লিস্টে যোগ করে ফেললাম এটিও।

জানুয়ারি মাসে বছর শুরুর আনন্দ আর হিম হিম ঠান্ডা নিয়ে কক্সবাজারের জনারণ্যে পৌছানোর পর থেকেই মাথায় ঘুরছিলো কখন যাব প্যারাসেইলিং এ। জানতাম দড়িয়ানগর যেখানে প্যারাসেইলিং করায় স্যাটেলাইট ভিশন, সে যায়গাটা সুগন্ধা বীচ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাই একটু বিকেল করেই বের হলাম দুই বান্ধবী, মনে আশা প্যারাসেইলিং শেষে হাতের একপাশে সমদ্র আর অন্যপাশে পাহাড় রেখে মেরিন ড্রাইভের সুনসান রাস্তা দিয়ে কনে দেখা আলোয় ফেরার ব্যাপারটা চেরি অন দ্যা কেক এর মতই হবে। কিন্তু বিধিবাম! দরিয়ানগর আমাদের হতাশার দরিয়ায় ডুবিয়ে জানিয়ে দিল, তাদের স্পীডবোটে সমস্যা, এই একটু আগে তারা প্যারাসেইলিং বন্ধ করে দিয়েছে।

কিন্তু এত সহজে দমে যাবার পাত্রী আমি নই। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ ঝুলাঝুলি করলাম প্যারাসেইলিং আবার চালু করানোর জন্য, তাতেও কাজ না হওয়ায় বিকল্প খুজতে শুরু করলাম। জানতাম কক্সবাজারে ফানফেস্ট নামে আর একটা গ্রুপ প্যারাসেইলিং করায়। কিন্তু তাদের ঠিকানা বা কন্ট্যাক্ট নাম্বার কিছুই ছিলনা আমার কাছে।

স্যাটেলাইট ভিউ কতৃপক্ষ থেকে তাদের ঠিকানা জোগাড় করলাম প্রথমে, তারপর এনাদেরকেই রিকোয়েস্ট করলাম ফোন করে ওখানে আমার জন্য বুকিং দিয়ে দিতে। কারন ফানফেস্ট মূল শহর থেকে বেশ দূরে, সেই হিমছড়ি ছাড়িয়ে ইনানীর কাছাকাছি প্রায়, আর দিনের আলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত, তাই বুকিং না দিয়ে এতদুর যেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে চাইনি।

বুকিং দেয়ার পরও একটু টেনশন কাজ করছিল, কারন ওখান থেকে বলে দিয়েছিল যেতে বেশি করা যাবেনা, সন্ধ্যার পর প্যারাসেইলিং করানো হয়না। কিন্তু রাস্তা এত বেশি সুন্দর যে মন এমনিই ভাল হয়ে যাচ্ছিল। বঙ্গপোসাগর বয়ে আসা লোনা বাতাসের হুহু শব্দ ছাড়া আশ্চর্য নির্জনতা এই চরাচর জুড়ে। পর্যটন এর ভরা মৌসুম, তারপরও গাড়ির বাহুল্য নেই। সোনালী আলোর বীচ বেয়ে একসময় পৌছলাম ফানফেস্টে। এরপর দৌড় দৌড় আর দৌড়। শত শত লাল কাকড়াময় বিশাল বালুকাবেলা দৌড়ে পার হয়ে একদম সমুদ্রের তীরে পৌছলাম। আমরাই আজকের দিনের শেষ প্যারাসেইলার।

ঝটপট পরে নিলাম লাইফ জ্যাকেট, কোমড়ে স্ট্রাপ দিয়ে বেঁধে বিশালাকৃতি বেলুনের দড়ি ধরিয়ে দেয়া হল দুইহাতে। সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্যের মাধ্যমে ইন্সট্রাক্টর বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে উড়তে হবে, কখন দড়ি ছেড়ে দিয়ে মুক্ত পাখি হয়ে যেতে পারব আর নামার সময়ই বা কোন পাশের দড়িতে টান দিতে হবে।

হুইসেল বেজে উঠতেই দড়ি ধরে দৌড়াতে শুরু করলাম, একসময় বুঝলাম আমি আর দৌড়াচ্ছি না, পা মাটি থেকে ফুটখানেক উপড়ে। ধীরে ধীরে উঠে গেলাম প্রায় চারশ ফুট উপরে, ততক্ষনে সূর্য অদৃশ্য হতে শুরু করেছে, উড়তে উড়তে সূর্য টুপ করে ডুবে যাওয়া দেখে হা করে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পায়ের নীচে দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি, আলো কমে যাচ্ছে আর শীতের সন্ধ্যার কুয়াশারা দলাপাকাচ্ছে সমুদ্রের ওপারে। ওই মূহুর্তের মত এমন আশ্চর্য নিস্তব্ধতা, কক্সবাজারে আর কখনো কোনদিন পাইনি।

সময় যেন ওখানেই থেমে গেছে, শুধু মাথার উপরে বহুবর্নের বেলুন, পায়ের নীচে সুনীল সাগর আর তার মাঝখানে লটকে আছি আমি। হঠাত অনুভব করলাম নীচে নামছি, পায়ের পাতা স্পর্শ করল ঢেউ, সমুদ্রের ফুসে ওঠা লোনা জল ঝাপটা মারল আমার মুখে। পাগলের মত হেসে উঠলাম একা একাই, তারপর আবার আমাকে নিয়ে শূন্যে উড়াল দিলো বিশালাকার বেলুন সদৃশ জিনিস টা। পাখির মত দুই হাত ছড়িয়ে শূন্যে ভাসা আমি মগ্ন হয়ে দেখলাম আমার বহু নীচ দিয়ে পাখিরা ঘরে ফিরছে দলবেঁধে। বীচে দাড়ানো মানুষগুলকে খেলনা পুতুলের মত লাগছে দেখতে। বেলুন টেনেবেড়ানো স্পীডবোটটাকেও কাগজের নৌকার মত দেখাচ্ছে। লিলিপুটদের দেশে আমি এক গালিভার, এমন একটা অনুভূতি হল।

একসময় শেষ হল নৌবিহার, স্পীডবোট বেলুনটাকে টেনে তীরের কাছাকাছি নিয়ে আসল, হুইসেল বাজিয়ে আমাকে সিগন্যাল দেয়া হল দড়িতে টান দেয়ার। ডান বাম গুলিয়ে ফেলার অভ্যাস থাকায় প্রাণপন শক্তিতে টানতে শুরু করলাম ভুল দড়ি, বেলুন তো কিছুতেই আর নামেনা। এদিকে নিচ থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছে সবাই ঠিক দড়ি টানার জন্য, সে শব্দ সাগরের হুহু বাতাস ছাপিয়ে কমই পৌঁছাচ্ছে আমার কানে, আমি আরো জোড়ে, সর্বশক্তি প্রয়োগে টেনে যাচ্ছি ভুল দড়ি। একসময় ইশারায় কাজ হল, বুঝলাম এবং ঠিক দড়ি ধরে টেনে নেমে আসলাম। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে পা চরাচর জুড়ে। ভাবলাম, ভুল হয়েছে হোক, আকাশে তো একটু বেশি সময় থাকতে পেরেছি!

কিভাবে যাবেনঃ

কক্সবাজারে বর্তমানে দুইটি প্রতিষ্ঠান প্যারাসেইলিং করায়। দড়িয়ানগরে অবস্থিত স্যাটেলাইট ভিশন সি স্পোর্টস এ ১৫০০, ২০০০ ও ২৫০০ টাকার তিনটি প্যাকেজ আছে। ফানফেস্ট বীচ এক্টিভিটিজ নামে অন্য প্রতিষ্ঠানটির সেবামূল্য ১৫০০-২০০০। ঠিকান -৯ ব্লক বীচ্, মেরিন ড্রাইভ, হিমছড়ি, কক্সবাজার। মোবাইল: ০১৭৩০৬৩৩৭৫৭, ০১৭৫৫৫৯৬৯৯৬, ০১৭৬২৫৯২৮৯২ ।

উভয় প্রতিষ্ঠানেই ১৫০০ ও ২০০০ টাকার রাইডের পার্থক্য হল, ১৫০০ টাকার তাতে শুধু আকাশে ওড়ায়, আর ২০০০ টাকার টাতে আকাশে উড়িয়ে সমুদ্রে পা স্পর্শ করায় তারপর আবার আকাশে ওড়ায়। ৩০০ থেকে ৪৫০ ফুট পর্যন্ত ওপরে ওঠানো হয়, রাইডের সময় সীমা ৭-১৫ মিনিট। কক্সবাজার এর সুগন্ধা বা কলাতলী বীচ থেকে রিজার্ভ অটো নিয়ে যেতে পারেন প্যারাসেইলিং করতে।

সৌজন্যে ঃ অনুভ্রমণ

শেয়ার করুন