কেমন বান্দরবান চাই?

কেমন বান্দরবান চাই? নির্বাচনের সময় এই কথা শুনে অনেকেই হয়তোবা মনে করবেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় ‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ না বলে কেন ‘কেমন বান্দরবান চাই ‘ কেন বলছি? আসলে আমি মনে করি, বান্দরবান বাংলাদেশের আর ৬৩টি জেলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে সারাদেশের মানুষ যা আশা করে তা এখানে জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যমান। তাই এগুলো নিয়ে আমার তেমন কোনো আক্ষেপ নেই। বান্দরবানের জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের সবচেয়ে কম। এটা বান্দরবানের সবচেয়ে ভালো দিক বলে আমি মনে করি। আরো ভালো দিক হচ্ছে এখানকার ১৩টি জাতিসত্ত্বার বৈচিত্র্য। বৈচিত্রেই  শক্তি। এই জিনিসটা খুব অনুভূত হয় এখানে। এছাড়াও বান্দরবানের স্বর্গীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য  যে বিশ্বনন্দিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

প্রত্যেক মুদ্রার যেমন দু’টো দিক তেমনি বান্দরবানের এত  ভালো কিছুর মধ্যেও যা সব কিছু ছাপিয়ে ব্যথিত করে তা হলো মুদ্রার পুরো উল্টোদিকের ন্যায় এর খারাপ দিকগুলো। দুঃখজনক হলেও সত্যি এ জেলা এখনো শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া একটি জেলা। শিক্ষা ও সম্পদে পিছিয়ে থাকায় বাকি সব অর্জন বা প্রাপ্তি শূন্য হয়ে যায়। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নে এখানকার নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

প্রথমত, বাংলাদেশে  শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জেলার অবস্থান থেকে উন্নত অবস্থানে নিতে হবে। শুধু বললেই হবেনা কাজেও তার প্রমাণ থাকা চাই। এই সর্বনিম্ন অবস্থান পরিবর্তন অসম্ভব কিছু নয়। সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পর্যাপ্ত পদ সৃষ্টি করে করে শিক্ষক সংকট দূর করতে হবে। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, কোনো শাস্তিমূলক বদলি যেন এখানে না হয়। যুগযুগ ধরে বান্দরবানে শাস্তিমূলক বদলি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি যৌন নিপীড়নের দায়ে দুই শিক্ষককে বান্দরবানে বদলী করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, মুন্সীগঞ্জের ছাত্রীদের ইজ্জত আছে আর বান্দরবানের ছাত্রীদের ইজ্জত নাই কি? বান্দরবানের মানুষ কি মানুষ না? করাপ্টেড, দুশ্চরিত্ররাই কেন এখানে আসবে শাস্তির জন্য? এই জেলা কি জেলখানা? শুধু স্কুল কলেজই নয়, সরকারি সকল ডিপার্টমেন্টকে এই শাস্তিমূলক বদলীর আওতামুক্ত করতে হবে। 

জেলার উন্নয়নে  সরকারি কর্মচারিদের শুধুমাত্র পাহাড়ি ভাতা পর্যাপ্ত নয়। যদি তারা আলাদা কোনো বেনিফিট পায় তবে উন্নয়নের আরো গতিশীলতা আসবে। কিন্তু কী এমন বেনিফিট দেয়া যায়? এক্ষেত্রে আমি বলবো, দুর্গম এলাকা হিসেবে এখানকার সরকারি চাকুরিজীবীদের বিনাসূদে কার লোন দেয়া যায়। বেতনগ্রেড অনুসারে তাদের এই লোন নির্ধারিত হবে। এই সুবিধা পেলে আমি নিশ্চিত কর্মচারিদের অফিস যাতায়াতের ঝক্কিঝামেলা অনেকটাই কমে যাবে।কর্মক্ষেত্রেও উপস্থিতির হার বাড়বে।

দ্বিতীয়, বান্দরবানের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্নরূপে আবাসিক করা চাই। ছাত্রছাত্রীর সমানুপাতিক হোস্টেল সুবিধা চালু করতে হবে। কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা ঝরে পরে শুধুমাত্র আবাসন সুবিধার অভাবে। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর  আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন ।

তৃতীয়ত, বান্দরবানকে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে আরো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। এ জেলায় সকল প্লাস্টিকজাত পণ্য নিষিদ্ধ করতে হবে। মিনারেল ওয়াটার, চিপ্স, বিস্কুট, জুস, আইস্ক্রিম, লাঞ্চ প্যাকেট ইত্যাদি পণ্যের মোড়ক যথাসম্ভব বিধিনিষেধের আওতায় আনতে হবে।এক্ষেত্রে একটি কাজ করা যায়, যেসব কোম্পানি এই প্লাস্টিক মোড়ক ব্যবহার করবে তাদেরই দায়িত্ব থাকবে তা পুনরায় সংগ্রহ করা। এতে কোম্পানিগুলো বাধ্যবাধকতার আওতায় আসবে। এছাড়াও দেখা যায় ট্যুরিস্ট আগমনহেতু এখানকার স্থানীয় জনগণের নানবিধ সমস্যায় পড়তে হয়।যেমন লাউডস্পিকারে উচ্চশব্দে গানবাজনা, ট্যুরিস্টদের হৈ-হল্লা, গাড়ির টিকিট না পাওয়া, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, ইকোসিস্টেমে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি নানা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে হবে।

এরপর আসে আমাদের চিকিৎসা সেবার কথা। বলা যায় চিকিৎসা ব্যবস্থার চিকিৎসা দরকার বান্দরবানে। সেই বাল্যকালে দেখেছি ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল। আমার বাবাও মারা গিয়েছিলেন সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায়। আমি নিজেও বছর খানেক আগে পেট ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছি। এতদিনেও হাসপাতালের অবকাঠামোর কোনো দৃশ্যমান উন্নতি আমার চোখে পড়েনি। সেইদিনও স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য গিয়ে শুনি ডাক্তার নাই। এটাকে চরম অবহেলা বলা যায়। একজন সরকারি ডাক্তার কীভাবে স্টেশনে থাকেন না, তা আমার বোধগম্য হয় না। স্থানীয় কয়েকজন ডাক্তার না থাকলে রোগীদের কি অবস্থা যে হতো, তা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।

বান্দরবানের অন্যতম  আরেকটি প্রধান সমস্যা এখানে সন্ধ্যার পর বিনোদনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। বনশ্রী সিনেমা হল ভেঙে নতুন কিছু হবে বলে শুনেছিলাম কিন্তু তার আর কোনো খবর আর পাইনি। সিনেমা হলটির স্থানে খোলা জায়গাটি যেন এখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ট্যুরিস্ট আসবে, দিনে ঘুরবে কিন্তু রাতে কী  করবে? মনে রাখতে হবে ট্যুরিস্ট আসে এখানে চুটিয়ে আনন্দ করতে। গৃহবন্দী হয়ে থাকতে নয়। এছাড়াও আমরা যারা স্থানীয় আছি তাদেরই বা একজায়গায় যেতে কত আর ভালো লাগে? এক্ষেত্রে আমি মনে করি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিদিন না হোক সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে তারা নানা আয়োজন করতে পারে যা উপভোগের জন্য দর্শককে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। এতে স্থানীয় ও পর্যটক উভয়েই লাভবান হবে। তাই আন্তর্জাতিক মানের না হোক অন্তত মানসম্মত সিনেমা হল ও বিনোদনের ব্যবস্থা করার দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।

সর্বশেষে আসে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। বান্দরবান-ঢাকা রুটে বিলাসবহুল গাড়ির কমতি নেই কিন্তু বান্দরবান-চট্টগ্রাম রুটের গাড়ি দীর্ঘদিন একটি সিন্ডিকেটের কবলে রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের কবল থেকে বান্দরবানবাসীর মুক্তি চাই। বলতে হয় বান্দরবান-কেরাণীহাট সড়ক খুবই সুন্দর। আমার বড়ভাই যিনি ইটালি থাকেন তার মতে এই রাস্তাটি ইউরোপের মত। ঝকঝকে তকতকে মসৃন। কিন্তু শহরের রাস্তাঘাট খুবই দুর্দশাগ্রস্থ। ময়লা আবর্জনার ছড়াছড়ি, ছোড়াছুড়ি দৃশ্যমান। এখানে অবশ্য আমাদের আমজনতার মানসিক দীনতাই দায়ী। আমরা দু’কদম হেটে নির্দিষ্ট জায়গায় ঘরের আবর্জনা ফেলতে পারিনা, আরেকজনের ঘরে ময়লা পড়লো কি পড়লোনা তা নিয়ে চিন্তা করিনা। এখানে সেখানে ময়লা ফেলায় আরেকজনের সমস্যা হচ্ছে কিনা ভাবিনা। এই মানসিকতার উন্নতি ও পরিবর্তনস্বার্থে একটি আইন করা যেতে পারে। বিশ্বাস করি এতে কাজ হবে।

উপর্যুক্ত চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ন আমার একান্ত। অনেকেই ভিন্নমত দিতে পারেন। আরো অনেক সু-ভাবনা আরো অনেকের থাকতে পারে। সবার সব সুন্দর চিন্তার প্রতিফলন নীতিনির্ধারকদের শুনতে হবে। ব্যবস্থা নেয়ার সামর্থ্য থাকলে তা পালন করতে হবে। তবেই পরিবর্তন আসবে। তবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যদি আমি চাই আমার আশপাশ সুন্দর হোক , পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুক তবে সবই সম্ভব। কয়েকদিন পরেই নতুন বছর আসবে। এই নতুন বছর নতুন কিছু নিয়ে আসবে সেই কামনাই করি।

  • মেহেদী হাসান, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, বান্দরবান সরকারি কলেজ।
শেয়ার করুন