প্রথাগত নিয়ম মানলে আজ তার পৃথিবীর কোন না কোন গবেষণাগারে গবেষণায় মগ্ন থাকার কথা। কিন্তু সৃষ্টিশীল এই মানুষটি ছোটবেলা থেকে লালন করা তার শখটিকেই বড় হয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি, যার ফলে আজ তিনি এক অনন্য উদ্যোগের কর্ণধার। সুমাইয়া সায়েদ, অনলাইন উদ্যোগ ‘আর্টোপলিস’ এর উদ্যোক্তা। শিশুদের জন্য নিরাপদ উপাদান দিয়ে হাতে তৈরী খেলনার বাজার তৈরীর উদ্দেশ্যেই মূলত: যাত্রা শুরু করে আর্টোপলিস। পরবর্তিতে সেই একই উপাদানের সমন্বয়ে হাতে তৈরী গয়না এবং টিপ এর জন্য ব্যাপক পরিচিতি পায় সুমাইয়ার উদ্যোগ।
আর্টোপলিসের শুরুর গল্পটা জানতে চাইলে সুমাইয়া স্মৃতি হাতড়ে একটু পেছনে চলে যান। সেই ছেলেবেলা থেকেই কাউকে উপহার দিতে হলে নিজের হাতে কিছু বানিয়ে দিতেই পছন্দ করতেন। মনের গভীরে ছবি আঁকা কিংবা সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি ভালবাসাটাই তার এই কাজগুলোতে ফুটে উঠতো। কিন্তু এই ভালবাসার সাথে লেগে থাকার ইচ্ছাটা প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি কখনো। আর তাই গতানুগতিক ধারায় শিক্ষক বাবা-মায়ের মেয়ে হিসেবে শিক্ষক হওয়ার প্রয়াস নিয়েই একসময় চলে যান লেখাপড়া করতে দেশের বাইরে।
“যখন দেশে ফেরত আসি, তখন আমি দুই সন্তানের মা। পড়ালেখা শেষ। বাইরে যাবার আগে আর ফেরার পর আমার অবস্থান, আমার কাছে অন্যদের প্রত্যাশা, সামাজিক প্রেক্ষাপট সবকিছু মিলিয়ে স্বস্তিবোধ করছিলামনা। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও বহুদিনের চেপে রাখা প্যাশনটাই তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। দেশের বাইরে থেকে আমি পরিকল্পনা করেই এসেছিলাম যে নিজের ব্যবসা দাঁড় করাবো। আর সেজন্য কাজের জন্য অনেক কাঁচামাল আমি সাথে নিয়েই এসেছিলাম। বাংলাদেশে শিশুদের খেলনা বা অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে টেকসই এবং নিরাপদ উপাদান হিসেবে ‘ফেল্ট ফেব্রিক’ ছিল আমার প্রথম পছন্দ। এই ফেল্ট ফেব্রিক দিয়েই শিশুদের জন্য ফিঙ্গার পাপেট দিয়ে আমার কাজ শুরু করি। পরবর্তিতে আমি গয়না এবং টিপ ডিজাইন শুরু করি। কিন্তু প্রাথমিক উপাদান হিসেবে ওই ফেল্ট ফেব্রিককেই ধরে রাখি।”- জানান সুমাইয়া।
এতকিছু থাকতে টিপ বানানো কেন? এ প্রশ্নের জবাবে সুমাইয়া বলেন, “সেসময় একটা আন্দোলনে আমার এক বন্ধু আর তার সহকর্মীদের ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হই। তাদের প্রত্যেকের কপালে এক বিশেষ ডিজাইনের টিপ ছিল যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তখন বাংলাদেশে কাস্টোমাইজড টিপের চাহিদা মাত্র শুরু হয়েছে। আমি তখন ওই বন্ধুর জন্যই টিপের ওপর কাজ করা শুরু করি। বিভিন্ন মেটাল চার্ম এবং রঙ, ফেব্রিক ব্যবহার করে ডিজাইন করি এবং অভাবনীয় সাড়া পাই। টিপ, গয়না কিংবা শিশুদের ব্যবহার্য জিনিস, যাই হোক না কেন, ডিজাইন নিখুঁত রাখতে পারাটা খুব প্রয়োজন। আমার কাজে আমি এই ব্যাপারটাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেই।”
অনলাইন ব্যবসা হলেও অফলাইন কার্যক্রম অর্থাৎ বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করেই মূলত: আর্টোপলিসের পরিচিতি বাড়ে। মেয়ে নেটওয়ার্কের ব্যবসায়িক প্ল্যাটফর্ম রাঙতা থেকে যে মেলার আয়োজন হয় তার অনেক গুলোতেই সুমাইয়া অংশ নেন। এছাড়াও বিবির পাবন, হুটহাট মেলা ইত্যাদি ইভেন্টগুলোকেই সুমাইয়ার উদ্যোগের বড় টার্নওভার বলে মনে করেন তিনি।
‘উদ্যোক্তা হিসেবে বড় গ্রাহক পরিমন্ডলের কাছে পৌঁছাতে চাইলে রাঙতা কিংবা এধরনের প্ল্যাটফরম আসলে খুব প্রয়োজন। এরকম সংঘে থাকলে নিজস্ব চিন্তারও বিকাশ ঘটে অনেক। এক্ষেত্রে আমি বলবো মেয়ে নেটওয়ার্কের সাথে আমার এই বিকাশ টা ঘটেছে।”-জানালেন সুমাইয়া।
আর্টোপলিস নামটা কেন? তাছাড়া একে আলতাপালিশ নামেও কেন ডাকা হয়? জানতে চাইলে সুমাইয়ার উত্তর, “যখন বিদেশে ছিলাম তখন সেখানে আমার খুব প্রিয় একটা গ্রীক রেস্টুরেন্ট ছিল। ওটার নাম ছিল আর্টোপলিস। কাকতালীয় ভাবে আমার পরিবারের চারজনের নামের অক্ষরই এই নামটাতে রয়েছে। তাই প্রিয় স্মৃতিময় জায়গার এবং প্রিয় মানুষের নামের আদ্যাক্ষর সম্বলিত এই নামটাই বেছে নেওয়া আমার নিজ উদ্যোগের জন্য।” হাসতে হাসতে সুমাইয়া শোনান মজার এক গল্প-“আমি বলি আলতাপালিশ হচ্ছে আমার আর্টোপলিসের ডাকনাম। প্রথমদিকে ডেলিভারি পার্সনরা পণ্য পৌঁছে দেয়ার সময় গ্রাহকদের বলতেন যে আলতাপালিশ থেকে পার্সেল এসেছে। কোন কারণে তারা আর্টোপলিসকে আলতাপালিশ বলতেন। এই নামটা আমার এবং আমার গ্রাহক-বন্ধুদের খুব মনে ধরে যায়। সেই থেকে আলতাপালিশ আমার উদ্যোগের ডাকনাম!”
একদম ভিন্নধারার এবং ভিন্ন আমেজের পণ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোন চ্যালেন্জের মুখোমুখি হয়েছেন কিনা, জানতে চাইলে সুমাইয়া বলেন, “নারীদের ক্ষেত্রে যেকোন কিছু করতে গেলেই পরিবারের কাজের চাপটা যেন পিছু ছাড়েনা। এক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয় সময়ের যথাযথ ব্যবস্থাপনা খুব দরকার। আর আমার কাজের ব্যাপারে বলবো, আমার প্রোডাক্ট কনসেপ্ট গুলোই অনেকক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে যদি আরটোপলিসের টিপের কথাই বলি। টিপগুলোর ডিজাইনগুলোতে নানারকম চার্ম ব্যবহার করি এবং এগুলো উপস্থাপনায় আমি সবসময় সবরকম সববয়সী নারীদের সামনে আনি। আমার ক্রেতাদের একটা বড় অংশ বডি নিউট্রাল। তাই আমার যে মার্কেটিং পলিসি তা তাদেরকে বিভ্রান্ত করেনা। কিন্তু আরেকটা অংশ এ ব্যাপারে অতটা সহনশীল আচরণ নাও করতে পারে। আমার কাজের মূল্যায়ন সেখানে হয়না বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। টিপ নিয়েই যেখানে আমাদের দেশে নানারকম বিতর্ক আছে, সেখানে এইসব বিষয়ে কাজের চ্যালেন্জ আসবে, তা তো বলাই বাহুল্য। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ইগো থাকাটাকেই আমি বলবো এর আরেকটা কারণ। তাছাড়া অনলাইনে ক্ষুদ্র আকারের ব্যবসা গুলোর নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কিছু আইনী জটিলতাও রয়েছে। সেগুলোও আমাদের মত শৌখিন পণ্যের উদ্যাক্তাদের একটা অন্যতম বড় চ্যালেন্জ”।
“টিকে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় ব্যাপার। এইমুহূর্তে আমি শুধুই টিকে থাকতে চাই।” নিজের উদ্যোগ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার হিসেবটা আপাতত তুলেই রাখতে চান সুমাইয়া। কেননা বর্তমান মহামারির সময়টাতে ছোট ছোট উদ্যোগের টিকে থাকার লড়াইটাই এখন সর্বাগ্রে। ছোট্ট হলেও তার উদ্যোগের সাথে শ্রম দেন তিনি সহ আরো চারজন। উদ্যোগের সাথে সাথে তাদের আয়-রোজগারের ব্যাপারটাও যেহেতু জড়িত, তাই আপাতত এই চিন্তাটাকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ বলে মনে করছেন এ উদ্যোক্তা।
ফেইসবুক পেইজের লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/artopolis.bd