পোষাপেটস নামটা হঠাৎ শুনলে বোঝা যায়না যে আসলে জিনিসটা কী? সহজে বলতে গেলে, পোষাপেটস হল আপনার আমার পোষা প্রাণীদের জন্য এক অনন্য ভরসার জায়গা। খুলেই বলা যাক।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। তাসনিম ইসলাম অর্ণা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কী করতে চান তখনও সে ব্যাপারে অনিশ্চিত সময় কাটাচ্ছিলেন। এক বন্ধু খবর দিল যে নারীদের জন্য একটা স্টার্টআপ উইকেনড আয়োজন করছে টেকস্টারস নামের প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র নিজের আইডিয়া নিয়েই সেখানে অংশ নেওয়া যাবে। শিক্ষার্থী এবং প্রফেশনালদের মিলন মেলা হবে সেটি। যারা কোন উদ্যোগ শুরু করতে চায় এবং যাদের ইতোমধ্যে কোন উদ্যোগ আছে এরকম মানুষেরা এখানে আসবে। কেউ চাইলে এখানে নিজের উদ্যোগের জন্য দল গঠন করতে পারে কিংবা কেউ চাইলে অন্য কারো উদ্যোগের সাথে যুক্তও হতে পারবে।
“আমি সেখানে শুধুই দেখতে গিয়েছিলাম। যেহেতু কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা আমার। তাই নিজের একটা আইডিয়া নিয়ে চলে গেলাম। মজার ব্যাপার হল আমার আইডিয়াটা কিন্তু পোষাপেটস ছিলনা।” বলছিলেন তাসনিম।
প্রথমদিন অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের আইডিয়া পরিবেশন করল। তাদের মাঝে একজন সানজিদা ফারহানার আইডিয়া ছিল পোষাপেটস। সানজিদা সেখানে এসেছিলেনই এই উদ্যোগের জন্য পার্টনার খুঁজতে। পেয়েও গেলেন তাসনিমকে।
সানজিদার পোষাপেটস এর সাথে যুক্ত হওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাইলে তাসনিমের জবাব, “পোষাপ্রাণীদের প্রতি গড়পড়তা মানুষের যে আচরণ কিংবা তাদের ব্যাপারে কিছু অমূলক ধারণার জন্য প্রাণীগুলোকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই ব্যাপারগুলো আমাকে কখনো স্বস্তি দেয়না। যখন এদের উপকারে আসবে এমন একটা কিছু করার সুযোগ পেলাম তখন আর দেরী করিনি।’’
‘‘প্রথমদিকে পোষাপেটস এর উদ্দেশ্য ছিল এমন আইওটি ডিভাইস বানানো যেটা পোষা এবং গৃহপালিত প্রাণীর সবরকম সমাধানস্থল হবে। বিচারকেরা সেরা আইডিয়া হিসেবে আমাদের পোষাপেটসকে বেছে নিলো।’’
‘‘এবার আইডিয়াকে বাস্তবে রূপান্তরের পালা। স্টার্টআপ উইকেনড থেকে বের হয়ে জরিপ করে আমরা শুধুমাত্র পোষাপ্রাণীদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আবার এও দেখলাম যে আইওটি ডিভাইস বানানোর মত অর্থবল কিংবা লোকবল কোনটাই এখনো নেই আমাদের। তাই ডিভাইস থেকে আপাতত দৃষ্টি সরিয়ে মনোযোগী হলাম পোষাপ্রাণীদের জন্য একটা প্লাটফরম তৈরি করার দিকে। এমন এক প্লাটফরম যেখানে পোষাপ্রাণীদের অভিভাবক এবং এই সংক্রান্ত সেবা প্রদানকারী সকলকে এক জায়গায় নিয়ে আসা হবে”।
পোষাপেটসের প্লাটফর্মে কী আছে?
পোষাপ্রাণীদের জন্য এখানে আছে নিজস্ব পশু চিকিৎসক যিনি বাড়িতে গিয়ে এবং অনলাইনে সেবা প্রদান করে থাকেন। এখানে আছে ই-কমার্স সাইট যেখান থেকে প্রাণীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ঔষধ সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। এইসব সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানিকৃত। এখানে আছে পোষাপ্রাণীর জন্য তিনটি হোটেল যেখানে প্রয়োজন হলে কেউ তার পোষাপ্রাণীকে কয়েকদিনের জন্য রেখে যেতে পারেন। এই হোটেলগুলো ঢাকার দক্ষিণখান, রায়েরবাজার এবং গাজীপুরে পরিচালিত হয়। এছাড়াও পোষাপ্রাণী সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের উপর ট্রেনিং এবং আদরের প্রাণীটির জন্য গ্রুমিং সেবাও দেওয়া হয়ে থাকে এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে।
এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও সানজিদা ফারহানা, সিএমও তাসনিম ইসলাম অর্ণা, সিটিও নাফিজুল ইসলাম, সিওও নাজমুল হাসান এবং সিএফও হিসেবে আছেন বাবু ইসলাম।
পোষাপেটস এর শুরুর গল্প এটাই। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই “পোষাপেটস” নিয়ে জিপি অ্যাক্সিলারেটর প্রোগ্রাম এবং ভারতে স্টার্টআপ জলসা উইকেন্ডেও অংশ নেয় তাসনিম- সানজিদার দল।
“জিপি অ্যাক্সিলারেটর প্রোগ্রামে আমরা তিন মাসের সম্পূর্ণ মেনটরশিপ লাভ করি। ১১০০ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে সেরা দশে এসে আমরা এই মেনটরশিপ অর্জন করি,” জানান তাসনিম।
‘‘করোনাকালীন অবস্থায় আমাদের এই উদ্যোগে তেমন প্রভাব পড়েনি। যদিও সেবার ধরনে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। যেমন অনলাইন কনসালটেন্সি চালু করতে হয়েছে। পেটস হোটেলের চাহিদা এখন একটু কম যেহেতু কেউ বাইরে যাচ্ছেনা।’’
খুব অল্প সময়ের মাঝেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে পোষাপেটস। ২০০ গ্রাহক দিয়ে শুরু করে এই কয়মাসেই এখন পাঁচশ’র বেশি গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই কম প্রতিকূলতাও পোহাতে হয়নি! তাসনিম বলেন, “এই উদ্যোগ টিকিয়ে রাখতে অর্থের প্রবাহ থাকা জরুরি। অনেক জায়গায় বিনিয়োগের চুক্তি হওয়ার পরও টাকা আটকে আছে। সময়মত রিসোর্স পাওয়া কিংবা তার সঠিক ব্যবহারের ঘাটতিও থেকে যায় কিছু ক্ষেত্রে।”
“কিন্তু এসবকিছু ছাপিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি একটা অ্যাপ ডেভেলপ করার যেটা পোষাপ্রাণীর অভিভাবক এবং সেবাদাতাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হবে। সবকিছু অটোমেটেড হবে, প্রতিটা গ্রাহককে বিশেষায়িত সেবা প্রদান করা হবে।”
পোষাপ্রাণীর জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি, তা হল ওদেরকে বুঝে সেই অনুযায়ী ওদের প্রতি আচরণ করা, ওদের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা। আর এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন তাসনিম। এই শিক্ষা শুধু পোষাপ্রাণীর অভিভাবকদের নয়, হতে হবে সর্বসাধারণের জন্য। যদিও প্রাণীবান্ধব পরিবেশ একদিনে গড়ে উঠবেনা, তাই এদের প্রতি সবার আরও সদয় ও উদার হওয়ার দিকে নজর দেওয়া একরকম সামাজিক দায়বদ্ধতা। সেই দায়বদ্ধতা থেকে পোষাপেটস কাজ করে যাবে নিরন্তর, সেই আশায় পথ চলছেন তাসনিম ইসলামের মত উদ্যোক্তারা।