মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইতালির নাগরিক ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহ রবিবার ভোরে দেশে আসবে।
ফাদার রিগান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা প্রদানের পাশাপশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ফাদার রিগনের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর এক বছর পর সরকারি ভাবে তার মরদেহ ইতালি থেকে দেশের আনার পর দুপুরে বাগেরহাটের মোংলার শেলাবুনিয়ায় গার্ড অব অনার প্রদানের পর সেন্ট পল্স গীর্জার পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হবে। সকালে মোংলা উপজেলা পরিষদ মাঠে দেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার মারিনো রিগনের সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ দুইয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব সুডানা ইকরাম চৌধুরী জানান, রবিবার ভোর ৫টায় তার্কিশ এয়ারলাইন্স’র ফ্লাইট TK-0712-তে করে মৃত্যুর এক বছর পরে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহ ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছাবে। সেখান থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় হেলিকপ্টার যোগে ফাদার রিগনের মরদেহ বাগেরহাটের মোংলায় পাঠানো হবে। ফাদার রিগনকে বহন করা হেলিকপ্টার মোংলার শেখ রাসেল স্টেডিয়ামে অবতরণের পর সকাল সাড়ে ৯টায় ফাদার রিগণের মরদেহ আনা হবে মোংলা উপজেলা পরিষদের মাঠে। সেখানে উপজেলা প্রাসনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুকে সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই ঘন্টা উপজেলা পরিষদের মাঠে রাখার পর মরদেহ নেয়া হবে ফাদার রিগনের প্রতিষ্ঠিত সেন্ট পল্স উচ্চ বিদ্যালয় এবং সেন্ট পল্স হাসপাতালে। সবশেষে শেলাবুনিয়ার সেন্ট পল্স গীর্জার সামনে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে সেখাইে রাস্ট্রীয় মর্যাদায় ফাদার মারিনো রিগনকে দুপুরে সমাধিস্থ করা হবে।
ফাদার রিগনের মরদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ফাদার রিগনকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে সরকার Friends of Liberation War Honour পদকসহ বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।
ইতালির নাগরিক ফাদার রিগন ১৯২৫ সারের ৫ ফেব্রুয়ারি সেদেশের ভিচেঞ্চায় জন্মগ্রহন করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে খৃষ্ট্রধর্ম প্রচারে জন্য ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারী তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গির্জায় ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাসহ অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা প্রদানের পাশাপশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেশ স্বাধীনের পর তিনি মোংলার শেলাবুনিয়ায় স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। ফাদার রিগন মোংলায় থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলন। এরপর ২০১৪ সালে তার ভাই মোংরায় এসে তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যান। ইতালিতে মৃত্যু হলে তার মরদেহ বাগেরহাটের মোংলার সেন্ট পল্স গীর্জার পাশে সমাহিত করতে হবে এই শর্তে তিনি ভাইয়ের সাথে যেতে রাজী হন। গত বছরের ২০ অক্টোবর ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধৃ ফাদার রিগন।
ফাদার মারিনো রিগন দীর্ঘ সময়ে মোংলায় অবস্থানকালে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের তিনশত পঞ্চাশটি গান, জসীম উদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এদেশের খ্যাতিমান কবিদের অসংখ্য কবিতা। অন্যদিকে ফাদার রিগন বাগেরহাট জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সেন্ট পল্স উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট পল্স হাসপাতালসহ প্রতিষ্ঠা করেন ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট পল্স সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র, যেখান থেকে মেয়েদেও সেলাই করা নক্সীকাঁথা রপ্তানি করা হতো বিদেশে। ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’র সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস রিগণ সম্পর্কে বলেন, তিনি ইতালিতে বাংলাদেশের অঘোষিত রাস্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সেন্ট পল্স উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফ্রান্সিস সুদান হালদার বলেন, ফাদার রিগন নিজেই বলতেন ‘আমার মস্তকে আছে রবীন্দ্রনাথ- অন্তরে রয়েছে লালন’।