সম্পর্কের উচ্চতায় উচ্ছ্বাস

দিল্লিতে শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি বৈঠক

নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠকে দুই নেতাই প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কের উচ্চতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা বিশ্ববাসীর সামনে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূলমন্ত্র উভয় দেশের নাগরিক জীবনমানকে উন্নত করা।

গতকাল শনিবার দুপুরে নয়াদিল্লির ঐতিহাসিক হায়দরাবাদ হাউসে বৈঠকে বসেন দু’দেশের সরকারপ্রধান। পরে তাদের উপস্থিতিতেই সাত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই এবং চুক্তিপত্র বিনিময় হয়। এরপর শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। খবর বাসস, ইউএনবি, বিডিনিউজ ও বিবিসির। 

শেখ হাসিনা হায়দরাবাদ হাউসে পৌঁছলে প্রধান ফটকে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী মোদি। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শুরুর আগে দুই নেতা কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলেন। এরপর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তারা। পরে সংবাদ সম্মেলনে তারা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। শীর্ষ বৈঠকের পর হায়দরাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা তার সম্মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। বৈঠক শেষে ৫৩ দফা যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয়, মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।

চুক্তি অনুযায়ী ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত। উপকূলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থার (কোস্টাল সারভেইল্যান্স সিস্টেম-সিএসএস) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে দুই দেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের বিষয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়েছে। তবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বহুল আলোচিত আসামের নাগরিকপঞ্জির প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো তাদের প্রাকৃতিক গ্যাস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রফতানি করবে বলে শনিবার দিলিল্গতে দুই দেশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। এলপিজি রফতানির জন্য একটি প্রকল্পেরও উদ্বোধন করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এই প্রকল্পে বাংলাদেশ থেকে বুলেট ট্রাকে চাপিয়ে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে আসা হবে ত্রিপুরার বিশালগড় বটলিং পল্গ্যান্টে, তারপর তা সরবরাহ করা হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন স্থানে। 

দুই নেতা যে তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন সেগুলো হলো- খুলনায় ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে বাংলাদেশ-ভারত প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে বিবেকানন্দ ভবন এবং বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় এলপিজি আমদানি প্রকল্প।

প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিগত এক দশকে উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রথাগত সহযোগিতা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন ও অপ্রচলিত খাত, যেমন- ব্লু ইকোনমি ও মেরিটাইম, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, মহাকাশ গবেষণা, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ রফতানি ও সাইবার সিকিউরিটি ইত্যাদি খাতে উভয় দেশ সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছে। এসব বহুমুখী ও বহুমাত্রিক সহযোগিতার ফলে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্ববাসীর সামনে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের মধ্যকার এই সম্পর্কের শুভসূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশের মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ ও সরকারের অপরিসীম অবদানের কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।’

এলপিজির প্রকল্প নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এটা উভয় দেশের বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করবে বলে আমি মনে করি। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জ্বালানি চাহিদা পূরণ অনেকাংশে সহজ হবে বলে আশা করছি। খুলনার বিআইপিএসডিআই বাংলাদেশের ওই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে বিভিন্ন রকম উন্নতমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে অবদান রাখবে বলে আশা করেন শেখ হাসিনা।

তিনি আশা করেন, ভারত সরকারের আর্থিক অনুদানে স্থাপিত রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ ভবন শিক্ষা বিস্তারে সহায়তার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘গত এক বছরে আমি ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে ৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছি। আজকে তিনটি প্রকল্প যোগ হয়ে এক ডজন যৌথ প্রকল্পের উদ্বোধন করলাম। এই প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য আমাদের নাগরিক জীবনমানকে উন্নত করা। এটা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূলমন্ত্র।’

সাত চুক্তি ও সমঝোতা :স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত; ওই পানি তারা ত্রিপুরা সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে।

উপকূলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থার (কোস্টাল সারভেইল্যান্স সিস্টেম-সিএসএস) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে দুই দেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের বিষয়ে এসওপি সই হয়েছে।

চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে। সহযোগিতা বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব হায়দরাবাদের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিনিময় নবায়ন এবং যুব উন্নয়নে সহযোগিতা নিয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার চার দিনের সরকারি সফরে ভারতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ রোববার তিনি দেশে ফিরবেন।

যৌথ ঘোষণায় তিস্তা ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ :দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ২০১১ সালে দুই দেশের সরকার যে অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোয় একমত হয়েছিল, কবে তার বাস্তবায়ন হবে, বাংলাদেশের জনগণ অধীর আগ্রহে সেই অপেক্ষায় আছে।

জবাবে মোদি বলেছেন, তার সরকার তিস্তায় সংশ্নিষ্ট সব পক্ষের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলেছে, যাতে যত দ্রুত সম্ভব তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা যায়। এ ছাড়া ছয়টি অভিন্ন নদীর (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার) জল কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, অবিলম্বে তার একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে দুই নেতা যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন।

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করতে অধিকতর প্রয়াস দরকার বলে দুই নেতা একমত হয়েছেন। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের নিরাপত্তা পরিবেশ ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েই সেটা করতে হবে। ভারত রাখাইন প্রদেশে এরই মধ্যে ২৫০টি বাড়ি বানিয়েছে এবং ফিরতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে আরও বাড়ি নির্মিত হচ্ছে, সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য দু’বছর ধরে ভারত যে মানবিক ত্রাণ পাঠিয়ে আসছে, সেজন্য ধন্যবাদও জানিয়েছে বাংলাদেশ।

ভারতের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন শেখ হাসিনা :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গতকাল শনিবার নয়াদিলিল্গতে রাষ্ট্রপতি ভবনে কোবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী এ আমন্ত্রণ জানান।

সাক্ষাৎ শেষে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সফর করতে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

ভারতের রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি রোল মডেল। সাক্ষাৎকালে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং মুখ্যসচিব নজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

‘ঠাকুর শান্তি পুরস্কার’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী :ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ অবদান রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ঠাকুর শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়েছে। গতকাল নয়াদিল্লির হোটেল তাজ প্যালেসে এক অনুষ্ঠানে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ইশা মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন। শেখ হাসিনার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়াত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে অনুষ্ঠানে সম্মাননাপত্র পাঠ করা হয়। পুরস্কার গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী তা দেশবাসীর প্রতি উৎসর্গ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এই সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তারা ভোটের মাধ্যমে আমাকে ক্ষমতায় এনেছে।’

বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় ভারত, প্রধানমন্ত্রীকে জয়শঙ্কর :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব’ দেওয়ার কথা জানালেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। গতকাল শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

পারস্পরিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে এই সাক্ষাতে উষ্ণ আলোচনা হয়েছে জানিয়ে টুইট করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাবীশ কুমার। সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, উপদেষ্টা গওহর রিজভী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল অনলাইন।

শেয়ার করুন