পড়ার অভ্যেস করলে কী উপকার?

প্রতিদিন পড়ার অভ্যেস একটি সুপার-পাওয়ার। অথচ এটি এখনকার দিনে সবচেয়ে অবহেলিত। যদি জানতে চান, আমার উপদেষ্টা কারা? আমি কমপক্ষে বিশ জন মানুষের নাম বলতে পারবো যাঁরা তাঁদের গল্প, ধারনা, ক্যারিয়ার এবং কাজ দিয়ে আমার চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু যদি মাত্র একজন উপদেষ্টা বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমি বেছে নেবো একটি বই। আমি এখনো এটা ভেবে অবাক হই যে, একটি মাত্র বই আপনার জীবনে কী পরিমাণ পরিবর্তন আনতে পারে।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপদেষ্টারা আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু বই যুগে যুগে, শতকের পর শতক ধরে তাঁদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বহন করে চলেছে। তাই, না-পড়ার সিদ্ধান্ত খুবই বোকামীপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

নিজের মধ্যে বিনিয়োগ করুন, প্রতিদিন পড়ুন
ব্লগ, সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি ছেড়ে দিনে অন্ততঃ ৩০মিনিট পড়ার পেছনে ব্যয় করুন। অনেক সম্পাদনা এবং গবেষণার পর একটি বই প্রকাশিত হয়।

কম সময়ে বেশি শিখতে চাইলে বই পড়াই একমাত্র সহজ উপায়। লেখকরা হাজার হাজার ঘন্টা ভেবে, গবেষণা করে, লিখে, সম্পাদনা করে তবেই বই প্রকাশ করেন। আর আপনি পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে এক মিনিটেরও কম সময়ে সেই বই পড়া শুরু করতে পারেন। পড়লে আপনার টাকা খরচ হবে, কিন্তু না-পড়লে টাকার চেয়ে অনেক বেশি কিছু খরচ হয়ে যাবে।

আগামীকাল সকালেও আপনি প্রতিদিনকার মতো প্রিয় কফির কাপে চুমুক দিতে পারেন, কিন্তু আপনার ভবিষ্যতের জন্যে এই কফির কোনো অবদান আছে? শুধু এটা পান করার সময় আপনার ভালো লাগতে পারে, এটুকুই তো!

অন্যদিকে বইয়ে একটি আলাদা ব্যাপার আছে। এটি নিজের মধ্যে বিনিয়োগের সবচেয়ে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। কারণ বই আপনার হৃদয় খুলে দেবে, ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে এবং কাজ শুরু করার প্রেরণা দেবে। তিন কাপ কফি বা অন্য পানীয় পান করার চেয়ে একটি বইয়ে বিনিয়োগ করুন। ওই বইয়ের একটি মাত্র আইডিয়া আপনার জীবন বদলে দিতে পারে।

স্মার্ট মানে আকর্ষনীয়
এখানেই একটি বইয়ের ক্ষমতা লুকিয়ে থাকে। আপনি হয়তো একটি বই পড়েছেন কিন্তু পড়ে কী লাভ হলো বুঝতে পারছেন না। একটু সময় নিন, ধীরে ধীরে বুঝবেন বই থেকে পাওয়া জ্ঞান একটি সমস্যার সমাধানে কীভাবে কাজে লেগে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে যখন আপনার জ্ঞান বাড়বে, আপনার ব্রেইন যখন সৃষ্টিশীল কাজের সাথে সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হবে- তখনই আপনি হয়ে উঠবেন শক্তিমান মানুষ।
একজন আকর্ষনীয় মানুষের কথা ভাবুন। যিনি জানেন, কৌতুহলী এবং শিখতে আগ্রহী। জ্ঞান মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, সম্ভবতঃ এটাই সফল এবং ব্যর্থ মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য।

আবেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়া
স্কুলজীবনে আমি খুব বেশি পড়তাম না। কারণ তখন নিজের পছন্দমতো পড়ার সুযোগ ছিলোনা। বরং জোর করে পড়ানো হতো। বিভিন্ন দিকে ভ্রমণ শুরু করার পর থেকে বই পড়া এবং বই থেকে শেখার বিষয়টি নতুন করে আবিষ্কার করলাম। পড়ে পড়ে আমি আবেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম।

বই পড়ার বিষয় ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো কিছুতে আফসোস নেই। মৃত্যুর আগে আমি এক হাজার ভালো বই পড়তে চাই। গত বছর ১২টি বই পড়ে শেষ করতে না পেরে বুঝলাম, এখন যে নিয়মে বই পড়ছি তাতে সারা জীবনে ১শ’ বইও শেষ হবেনা। আমাকে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে এবং বই পড়াকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। বই পড়াটাকে যখন সকালের রুটিনে যোগ করলাম, বছরে ২৪টি বই পড়ে শেষ করা আমার পক্ষে খুব সহজ হয়ে গেলো।

খুব সহজ যে কাজটি আমি করলাম তা হলো, ঘুম থেকে ওঠার পর পানি খেয়ে, হালকা ব্যায়াম, নাস্তা এবং মেডিটেশনের পর ২০পৃষ্ঠা করে বই পড়তে লাগলাম। আমার যখন পড়তে ইচ্ছে হতো শুধু তখন নয়, প্রতি সকালে নিয়ম করে ২০পৃষ্ঠা বই পড়তাম যাতে মাত্র ২৫-৩০ মিনিট সময় লাগতো।

প্রতিদিন পড়ার একটা শর্টকাট রাস্তা পেয়েছি
দুঃখিত! এর কোনো শর্টকাট হয়না। এই বয়স পর্যন্ত আমি নিজেকে খুব স্মার্ট ভেবে যে-কোনো কাজের শর্টকাট রাস্তা খুঁজে বেড়িয়েছি। দ্রুতগতিতে পড়ার অভ্যেস করতে চেয়েছি, অডিওবুক শুনে দেখেছি, ছবি আঁকা বই পড়েছি যেগুলোতে শুধুমাত্র মূল বিষয়গুলো উল্লেখ থাকতো এবং বাকিটা ছবিতে বোঝানো হতো, কোনো কোনো বইয়ের শুধুমাত্র সারসংক্ষেপ পড়ে কাজ চালিয়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি।

প্রথমতঃ মনে হতো, নিজের সাথে প্রতারণা করছি। দ্বিতীয়তঃ, একটা বইয়ের ভেতর থেকে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানগুলো গ্রহণ এবং অপ্রাসঙ্গিক তথ্যগুলো ভুলে যাওয়ার কাজটা আমার কাছে কঠোর পরিশ্রম মনে হতো। কিন্তু পড়ার শর্টকাট রাস্তায় কাজ হলোনা। অবশেষে মেনে নিলাম, একটু বেশি সময় ব্যয় এবং সময়টাকে উপভোগ করতে শুরু করলেই আমার পক্ষে বেশি পড়া সম্ভব হবে। পড়ার অভ্যেসটাকে আমি খুব কঠোরভাবে নিলাম- ৩০ মিনিট প্রতিদিন। আমি পড়তাম আর ঘড়ি দেখতাম, আর কয় মিনিট বাকি আছে। আমি যখন বেছে বেছে পছন্দের লেখাগুলো পড়া শুরু করলাম, পড়ার প্রতি আমার ধারনাই পাল্টে গেলো। পড়াকে ভালোবাসতে শিখে ফেললাম।

উপদেষ্টা
পড়াকে আমি নিজের উপদেষ্টা হিসেবে দেখি। আমি জানি, আপনার আচরন এবং কাজে আশপাশের পরিবেশের বেশ ভালো একটা প্রভাব আছে। জিম রন বলেছেন, ‘আপনি হলেন সেই পাঁচ জন মানুষের গড়, যাদের সাথে আপনি সবচেয়ে বেশি সময় কাটান’। আমি এটার সাথে খুব বেশি একমত নই। আপনি যদি একটা মানুষের সাথে এক ঘন্টা সময় কাটান, আর এক ঘন্টা একটা বই পড়েন তাহলে সেই বইটা আপনার ওই পাঁচ জন মানুষের মধ্যে একজন হয়ে ওঠে। যদি সফল ব্যক্তিদের লেখা পড়েন, যাঁরা বছরের পর বছর গবেষণার পর একটি বই লিখেছেন- আপনি মুহূর্তেই সমৃদ্ধ, স্মার্ট এবং বেড়ে ওঠার উপযুক্ত হয়ে যাবেন।

কেন সকালে পড়বেন?
সকালেই পড়তে হবে এমন নয়। আমি ঘুম ভাঙ্গার পরই পড়ি কারণ পড়লে চিন্তাভাবনায় সৃষ্টিশীলতা আসে। পড়ার পর আমার মনে হয় কিছু অর্জন করলাম। মনে হয় নিজের জন্য কিছু বিনিয়োগ করলাম। আমি জানি, এভাবে বেশ কিছুদিন গেলে আমি অনেক স্মার্ট হয়ে উঠবো, যে কোনো বিষয়ে আমার ভালো জ্ঞান থাকবে। সেটা হোক কিছু লেখা, কোথাও বক্তৃতা করা অথবা খুব সাধারণভাবে কারো সাথে কথা বলা- আমি অনেক আকর্ষনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবো। সকালের সময় এবং পড়া দু’টোই নিজের মধ্যে বিনিয়োগের খুবই ভালো সময়।

আপনার পড়ার অভ্যেস কেমন? প্রতিদিন পড়ার জন্যে আপনার জীবনধারায় কেমন পরিবর্তন আনবেন?

লেখক: টমাস লরিনাভিসিয়াস, ফোর্বস ম্যাগাজিন-এর প্রাক্তন কন্ট্রিবিউটর। ভাবানুবাদ: ফরিদুল আলম সুমন

শেয়ার করুন