সপ্তাহখানেক আগে একটি বিয়োগান্ত সংবাদের সহমর্মী হতে বাইকযোগে রাঙামাটি যাচ্ছিলাম। পথের দুইপাশে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্পের সাইনবোর্ড ছিল চোখে পড়ার মতো। আমি বার বার এসব দেখিয়ে সফরসঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছিলাম। তিনিও কিছুটা বাধ্য হয়েই সায় দিলেন। কিন্তু জটিল একটি প্রশ্নেরও অবতারণা করলেন। তিনি বললেন, এসব প্রকল্প সঠিক মানুষের ভাগ্যে জুটেছে কীনা; সেটিও দেখা দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের একটি ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন স্বচ্ছ ও ন্যায্য একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি আরো বললেন, নিয়োগে ন্যায্যতা-উন্নয়ন কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা-প্রকল্প বরাদ্দে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি জনমনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এসব কারণেও পাহাড়ে অশান্তি জিইয়ে থাকার অন্যতম উপাদান হিশেবে কাজ করছে।
তাঁর এই নসিহত মনে দারুণ দাগ কেটেছে। ফিরতি পথে ভাবতে ভাবতে পথ চলতে চলতে আরেক জায়গায় চোখ থেমে যায় অন্য দৃশ্যে। কয়েকজন সবল-সুস্থ যুবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্ভবত মালবাহী যান থেকে চাঁদা তুলছিল। তাঁদের দেখে আমার লেখাপড়া জানা মনে হয়েছে। আপনমনে প্রশ্নের উদ্রেক হলো, ‘এমন ভুল পথে মানুষ কেন পা বাড়ায়?
মনকে শান্তনা দিলাম, আমাদের মতো আমজনতা (ম্যাংগো পিপল)-এর দেশ-দুনিয়ার সমস্যা নিয়ে কীইবা করার আছে। একজন নগণ্য সংবাদকর্মী হিহেবে মনে সাহস ধরেই মনে করলাম, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমাদের সুবর্ণ পূর্ব-পুরুষরা জীবনের মমতা ত্যাগ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, মা-বোনরা সম্ভ্রম হারিয়ে ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’র নোনাজলকে বাড়িয়ে দিয়েছেন চোখের জলে। একজন মহান মানুষ ‘বঙ্গবন্ধু’র তর্জনী ঈশারায় ৩০ লক্ষ জীবন আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশটি স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু, নিজেই বলেছিলেন ‘এই স্বাধীনতা ভৌগলিক স্বাধীনতা’ এবং এও বলেছিলেন ‘মুক্তির সংগ্রাম চলবে..’। বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের সেই অসমাপ্ত সংগ্রাম একেবারে থেমে যায়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী’র জীবনবাজি রাখা যাদুকরী নেতৃত্বে সেটি অব্যাহত আছে। সেই নেতৃত্বের দ্যুতিতে পাহাড় কী আজ কম আলোকিত, এখানকার জনপ্রতিনিধি-পাহাড়ি-বাঙালি আমরা সবাই কী এগিয়ে যাচ্ছি না?
‘আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সময়ে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো, সুশাসনের অভাব-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-অনিয়ম এবং দুর্নীতি। এসব সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা, জনগণকে শান্তির পথ বাতলে দেয়া এবং সুন্দর আগামীর নিশ্চয়তা বিধান জনপ্রতিনিধিদের নৈতিক দায়িত্ব। সাধারণ মানুষ, সংবিধান-আইনকানুন ও বিধিবিধান বোঝেন না। বোঝার লোক হিসেবে তাই অন্ধের মতো ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে তিন পার্বত্য জেলার প্রতিটি খাতে কী পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, এটি সবার কাছে পরিস্কার না হলেও সহজে অনুমেয়। যেমন কারো কারো গাড়ি-বাড়ি বাড়ছে তেমনি সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে প্রতিটি উপজেলা সদরে ইলেকট্রনিক্স-এর দোকানও বাড়ছে। সমতলের মতো বড়ো বড়ো শপিংমল গড়ে উঠছে। ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবহারের সীমা ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলা পর্যায়েও। এটি কম কথা নয়।’
আমার এতোসব অনুমাননির্ভর সূচক উপস্থাপনের জবাবে সফরসঙ্গী বললেন, তাতে তো মানুষের মনে স্বস্তি মিলছে না। জনগণের মনের খবরটা আসলে কী, তা জানার এবং বোঝার শক্তি তো আসলেই আমাদের নেই। জনতার প্রতিনিধিরাই জনতার ব্যথা-বেদনা ভালো বুঝবেন।
অল্প কিছুদিন আগে দীঘিনালার জারুলছড়ি ও মেরুং, মাটিরাঙ্গার তাইন্দং-তবলছড়ি এবং বাঘাইছড়ির সাজেক এলাকা ঘুরেছিলাম। এসব এলাকার এমন মানুষও আছেন; যাঁরা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য-এর নাম জানেন না। এসব এলাকায় উন্নয়ন বৈষম্য কতোটা ভয়াবহ তা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। অথচ সাজেক-এর রুইলুই পর্যটন কেন্দ্র দেখেই আমরা ধরে নেই যে, সাজেকবাসী; রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি শহরের বাসিন্দাদের চেয়েও ভালো আছে। একেবারে নেই বললেও ভুল হবে। সেই হাতেগোণা কয়েক ওপরের তলার মানুষ-ই।
ফিরে আসি, মূল প্রসঙ্গে। সমতল আর পাহাড়ের সবকিছুতেই আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কয়েক শতাব্দী ধরেই বাংলা ভূ-খন্ডের পার্বত্য তিন জেলার সাথে সমতলের মানুষের মানস-মনন এবং উন্নয়ন বৈষম্য আকাশ উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানী চিন্তার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ স্বাধীনের পাঁচ বছর না যেতেই পার্বত্যাঞ্চলের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের খবর বর্হিবিশে^র টনক নাড়িয়ে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান এবং অতীত পরিবেশ-পরিস্থিতি কমবেশি এখন সবারই জানা। তবে ভবিষ্যত কেমন তা বোধগম্য নয়। অতীত-বর্তমানের রাজনৈতিক ব্যাকরণ ও রসায়ন মিলিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পক্ষে একটি ধারণা দাঁড় করানো সম্ভব।
আর সব সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারবেন জনবান্ধব জনপ্রতিনিধিরাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয়, একটি সংরক্ষিতসহ চারটি সংসদীয় আসন, ২২ সস্যের একটি আঞ্চলিক পরিষদ, একটি শক্তিশালী উন্নয়ন বোর্ড, তিন চেয়ারম্যান এবং ৪২ সদস্য নিয়ে তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, ২৬টি উপজেলা পরিষদ এবং একশ’র কাছাকাছি ইউনিয়ন পরিষদ। এর বাইরে রয়েছে তিনটি সার্কেল প্রধান, শত শত হেডম্যান বা মৌজা প্রধান এবং কয়েক হাজার পাড়াপ্রধান বা কার্বারি। উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্বারী ছাড়া বাকী সব প্রতিষ্ঠান প্রধানই সরকারি ও দাতা গোষ্ঠির সহযোগিতায় যখন যা খুশী, তখন তা করতে পারছেন। এই স্বাধীনতার সুফল এবং কুফল-এর সব নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপরই বর্তাচ্ছে। বেশিদূর যেতে হবে না। ধরুন, একটি পার্বত্য জেলাসদরের কাছাকাছি একটি গ্রাম। আপনি গেলেই দেখতে পাবেন বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠান। আবার দেখা যাবে, অকেজো হয়ে পড়ে আছে আরো অনেক নলকূপ। আবার কোন কোন গ্রামের মানুষ জানেই না যে, তাঁদেরও একটি নলকূপ পাবার অধিকার আছে।
একজন প্রভাবশালী মানুষের গ্রামে যাবেন, দেখবেন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অবকাঠামো গড়ে উঠছে। ভালো অবকাঠামো ভেঙ্গে আবার নতুন করে বানানো হচ্ছে। স্কুলে শিক্ষার্থীর তুলনায় ভবনের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে অহেতুক। আত্মীয় স্বজনের সুবিধার্থে একই এলাকায়, ঘুরেফিরে একই মানুষের কপালে জুটছে একের পর এক সরকারি প্রকল্প। অর্থবছর শেষেই সেব অবকাঠামোর কোন কোনটিতে ক্ষমতাবানের স্বজনের ভোগদখলে চলে গেছে। আর তার পাশের বা একটু দূরের গ্রামের মানুষের কপাল পুড়ছে। কী বলবেন, সবাই তো জনগণ। আর জনগণের জন্যই সব করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকার প্রধানের সদিচ্ছায় খুবই দ্রুততার সাথে তিন পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ এগিয়ে চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে এটি অন্যতম। অথচ এই প্রকল্পের আওতায় যেখানেই বিদ্যুৎ যাচ্ছে, সেখানে জনগণকে পিলারপ্রতি টাকা গুণতে হচ্ছে। জনগণ কলুর বলদের মতো বিদ্যুতের আশায় ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন। জেলা পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার নজির সৃষ্টি করেছে। সেই তিনটি পরিষদে বরাদ্দের পরিমাণও বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানে জনগণের হয়রানির মাত্রা-পরিমাণ ও ক্ষেত্র; কতো প্রকার ও কী কী, তা একমাত্র ভুক্তভোগী জনগণই হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন। কারণ, এই তিনটি প্রতিষ্ঠান দুই দশকের বেশি সময় ধরেই অনির্বাচিত ও সরকার মনোনীত ব্যক্তিবর্গ দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। যেহেতু তাঁদের জনগণের মুখাপেক্ষি হয়ে ক্ষমতার পদে বসতে হয়নি, সেহেতু বিদায় কালেও জনতার মুখোমুখি হতে হবে না। সুতরাং দায়বদ্ধতা শব্দটি শিকেয় তুলে রাখা যাক।
তিন পার্বত্য জেলার মানুষের কাছে কার্যকর জনপ্রতিনিধি হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হলেন তিন আসনের তিনজন মাননীয় সংসদ সদস্য। সৌভাগ্যক্রমে রাঙামাটির সংসদ সদস্য একজন ত্যাগী-সাহসী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক। বান্দরবানের সংসদ সদস্য তিনটি আসনের মধ্যে জনপ্রিয়তায় অনন্য উঁচুতে অবস্থান করছেন। আর খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য একজন রাজনীতিকের পাশাপাশি শিক্ষা ও সমাজ অনুরাগী হিসেবে সুপরিচিত। তাঁদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তাঁরা প্রতিনিয়তই এলাকায় সময় দিচ্ছেন। সুখে-দুঃখে পাশেও দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের খবর জানার জন্য সাধারণ মানুষকে সুযোগ দিতে হবে। বড় বড় মানুষকে ঠেলে সাধারণ মানুষ-গ্রামের খেটে খাওয়া, জুমচাষী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, একজন ভর্তিচ্ছু মেধাবী শিক্ষার্থী, একজন ভালো শিক্ষক অথবা একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ যাতে সহজে আপনাদের কাছে পৌঁছাতে পারেন-‘নির্ভয়ে অভাব-অভিযোগ-অভিমান প্রকাশ’-এর সুযোগ পান; সেই পথ সহজ করতে হবে। নিজের রাজনৈতিক আদর্শের তৃণমূলের একজন কর্মী’র মতোই সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমার জানা মতে, সমতলের মতো তিনটি পার্বত্য জেলার সম্মানিত জেলা প্রশাসক মহোদয় সাধারণ জনগণের সাথে উন্মুক্ত সাক্ষাতের জন্য সপ্তাহের একটি নির্ধারিত সময় বরাদ্দ রাখেন। এবং সেটি তাঁদের কার্যালয়ে বিজ্ঞপ্তি আকারেই ঘোষিত। একজন সংসদ সদস্যের ব্যস্ততা অবশ্যই একজন জেলা প্রশাসকের চেয়ে অনেক বেশি। তবু মনে হয়, পরীক্ষামুলকভাবে ‘ফেইস টু ফেইস’ জনগণের কাছে আসা এবং থাকার চেষ্টা করাই উত্তম। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৭ সালে কঠিন রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েই ‘ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষর করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে কঠিন খেসারতও দিয়েছিলেন। টানা তিন মেয়াদেও তিনি পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নে অঢেল বরাদ্দ দিচ্ছেন। আর তাঁর এই অপত্য ভালোবাসার দায় যেমন জনগণের তেমনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও।
এতোসব নেতিবাচক অভাব-অসংগতির মাঝেও বলতে হয়, এসবের সমাধান সম্ভব। আশাবাদী মন নিয়েই ‘উন্নত-সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম’-এর আশায় বাকীটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
প্রদীপ চৌধুরী, পাহাড়ের সংবাদকর্মী