জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ ফিরে আসছে মারাত্মক সব রোগব্যাধি

পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে তাপমাত্রা। এর ফলে হাজার বছরের হিমশীতল পার্মাফ্রস্ট (বরফের স্তরে থাকা জমাট মাটি) গলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলে বরফ মাটির নিচে এতদিনের সুপ্ত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস মুক্ত হয়ে সজীব হয়ে উঠছে। জানা গেছে, পৃথিবীর বেশিরভাগ পার্মাফ্রস্ট সঞ্চিত হয়ে আছে উত্তর গোলার্ধের আর্কটিক অঞ্চলে। তাই এই অঞ্চলে যখন কোনো প্রাণী মারা যায় তা সাধারণ প্রাণীর মতো মাটিতে মিশে যায় না, এরা পার্মাফ্রস্টের বরফে মমিতে পরিণত হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাজার বছর ধরে জমাট বেঁধে থাকা এই বরফ গলতে শুরু করেছে। ফলে এর মধ্যে থাকা প্রাণীর দেহে অবস্থান করা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াও জেগে উঠতে শুরু করেছে।

সংক্রামক রোগের মধ্যে অন্যতম হলো অ্যানথ্রাক্স। এর জন্য দায়ী ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামের একটি ব্যাকটেরিয়া। ১৯৪১ সালে সর্বশেষ রাশিয়ার ইয়ামালে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ হয়েছিল। রুশ বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, ৭৫ বছর আগে এই এলাকায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু বলগা হরিণ মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার পরে এদের মৃতদেহ পার্মাফ্রস্টে ফেলে রাখা হয়। এদের দেহে থাকা ঘাতক ভাইরাসও অক্ষত অবস্থায় থেকে যায়। দীর্ঘদিন পরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পার্মাফ্রস্ট একটু একটু গলতে শুরু করে এবং সেই মৃত বলগা হরিণের মৃতদেহ আবার উন্মুক্ত হয়ে যায়। ফলে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু আশেপাশের পানি এবং খাদ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে সেই অঞ্চলে থাকা প্রায় দুই হাজার বলগা হরিণ আক্রান্ত হয় এবং এদের রক্ষণাবেক্ষণ করা মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। জনবসতি অনেক কম হওয়ায় এবং সরকার সেনাবাহিনীর ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন’ বিশেষজ্ঞদের দল দ্রুত পাঠায় এবং আক্রান্ত এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়। ফলে খুব বড় আকারে মহামারি ছড়িয়ে পড়েনি।   

পার্মাফ্রস্টকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন প্যান্ডোরার বাক্স, কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন এতে ঘাতক জীবাণু দীর্ঘ সময় ধরে অক্ষত অবস্থায় থাকতে পারে, রাশিয়ার ঘটনাটি এর একটি ছোট প্রমাণ মাত্র। ইতিহাসের পাতায় খুঁজে না পাওয়া কোনো জীবাণু যার সঙ্গে আধুনিক মানুষের কোনো দেখা হয়নি, এমন কিছুও হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে এই বরফের ভেতর থেকে, এমন আশঙ্কাও করছেন বিজ্ঞানীরা। ইতিহাসবিদেরা বলছেন, শুধু বিংশ শতাব্দীতেই অ্যানথ্রাক্সের মহামারিতে দশ লাখের অধিক বলগা হরিণ মারা গিয়েছিল সাইবেরিয়া এলাকায়। মহামারির সময়ে মৃত হরিণ গর্ত খুঁড়ে চাপা দেয়ার সময় সুযোগ ছিলো না মানুষের হাতে। ফলে তাদের মাটির অল্প গভীরেই পুঁতে রাখা হয়। দীর্ঘদিনের বরফ জমার ফলে সেই জায়গাগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে এই ধরনের সাত হাজার হরিণের সমাধিক্ষেত্র আছে। এই সমাধিক্ষেত্র অবমুক্ত হয়ে পড়লে মহামারি সময়ের ব্যাপার মাত্র।  

শুধু মহামারিতে মারা যাওয়া প্রাণীই নয়, বিভিন্ন সময়ে রোগে আক্রান্ত মানুষকেও সমাহিত করা হয়েছে বরফে। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর সময় মানুষকে আলাস্কার তুন্দ্রা অঞ্চলে সমাহিত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই কবর থেকে বিজ্ঞানীরা স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের আরএনএ খণ্ড বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে মহামারি ছড়ানো প্লেগ আর গুটিবসন্তের সময় অসংখ্য মানুষকে সাইবেরিয়ায় সমাহিত করা হয়েছে। তবে শুধু সাইবেরিয়াতেই নয় যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কাতেও নাসার বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই এমন আশঙ্কার প্রমাণ পেয়েছিলেন।

২০০৫ সালে আলাস্কার জমাটবদ্ধ একটি পুকুর থেকে ৩২ হাজার বছর পুরাতন একটি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন তারা। ব্যাকটেরিয়াটির নাম ‘কার্নোব্যাকটেরিয়াম প্লেইস্টোসেনিয়াম’ (Carnobacterium Pleistocenium)। পৃথিবীজুড়ে যখন লোমশ ম্যামথদের পাওয়া যেত, তখনকার নমুনায় পাওয়া যায় এদের। বরফ গলে গেলে এই ব্যাকটেরিয়া আবার পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তবে সব ব্যাকটেরিয়া এই দীর্ঘ সময়ের সুপ্তাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে না।

অ্যানথ্রাক্সের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ‘স্পোর’ তৈরি করতে পারে। এই স্পোর দীর্ঘদিন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।   বিজ্ঞানীরা অহরহই এমন উদাহরণ পাচ্ছেন যেখানে শত শত বছরের পুরোনো নমুনা থেকে ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব মিলছে। তবে আশার কথা ভাইরাস পোষকদেহ ছাড়া খুব বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে না। তবে মেরু এলাকায় মানুষের আনাগোনা যত বাড়ছে এই ভাইরাসগুলো দিয়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা তত বাড়ছে।   সম্প্রতি চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে সারাবিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে একটিমাত্র শহর থেকে কীভাবে বৈশ্বিক মহামারি ছড়ানো সম্ভব। তাই প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু’র মতো যেসব রোগ পেছনে ফেলে এসেছি বলে নিজেদের বাহবা দিচ্ছি অচিরেই সেগুলো কি আমাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে? বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কি মানবজাতিকে ঠেলে দেবে জীবাণুর আক্রমণের মুখে? শুধু সময়ই হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে!

শেয়ার করুন