খেলাধুলা বাদ দিয়ে জুয়া ব্যবসায় ক্লাব কর্মকর্তারা

রাজধানীর ক্লাবগুলোতে খেলাধুলাকে বিদায় দিয়ে চলছে জুয়া ও অসামাজিক কার্যকলাপ। একটা সময় ক্লাবগুলো ছিল শুধুই খেলাকেন্দ্রিক। মোহামেডান, দিলকুশা, আরামবাগ, মুক্তিযোদ্ধা, কলাবাগান, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারীর মতো দলগুলো ঢাকার মাঠ কাঁপিয়েছে ফুটবল কিংবা হকি দিয়ে।

এখন এই ক্লাবগুলোর বড় অংশেরই জুয়ার টাকায় জৌলুশ বেড়েছে, কিন্তু খেলোয়াড়দের সেই ক্লাবে ঠাঁই নেই। এই কারণে খেলাধুলার মান উন্নয়ন এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আর ক্লাবগুলোয় জুয়া/ক্যাসিনো পরিচালনাকারীরা কোটি কোটি টাকা বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করছে। অনৈতিক এ কাজ যাতে অবাধে চলে সেজন্য নির্ধারিত হারে চাঁদা পেতেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির কর্মকর্তারা।

সম্প্রতিকালে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ক্যাসিনো সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানতে চাইলে, জানিয়ে দেওয়া হয়, কোন ধরনের ক্যাসিনো নেই। অথচ র‌্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে ক্লাবগুলোর অভ্যন্তরে ক্যাসিনা ও অসামাজিক কার্যকলাপের রমরমা বাণিজ্য। অসামাজিক কার্যকলাপ সুরক্ষায় নিয়মিত পাহারাও দিতেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য। তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। মোহামেডান ক্লাব ও ক্রিকেট বোর্ডের গ্রেফতারকৃত পরিচালক লোকমান হোসেন জিজ্ঞাসাবাদে বিদেশে টাকা পাচার, ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ সিলগালা করে দেয়। তবে বিষয়টি এমন নয় যে ওই দিন কিংবা দিন কয়েক আগে প্রথম ক্যাসিনো চালু হয়েছে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায়। বিগত সরকারগুলোর আমলে এইসব ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চলে আসছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, খেলাসংশ্লিষ্ট লোকজন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের একাধিক সূত্র বলেছে, ক্যাসিনোগুলো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেক লীগের তিন জন শীর্ষ নেতা চালাতেন। তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন এবং ক্লাবগুলোর কাজকর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না-এমনটাই মনে করে আসছিলেন সবাই।

গতকাল বৃহস্পতিবার খেলোয়াড়, ক্লাব কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কীভাবে ক্লাবগুলো ঘিরে খেলার বদলে জুয়া মুখ্য হয়ে উঠল, সে বিষয়ে কথা বলেছেন তাঁরা। ঢাকার প্রাচীন একটি ক্লাবের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্লাবগুলোয় জুয়ার প্রচলন বরাবরই ছিল। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে হাউজি খেলা হতো। ওই টাকায় ক্লাবের দৈনন্দিন খরচা চলত।

জুয়াটা রমরমা হয়ে উঠতে শুরু করে নব্বইয়ের দশক থেকে। ক্লাবগুলো তখন মাত্র মতিঝিল এলাকায় এসেছে। খেলাধুলার খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনুদানের টাকায় ক্লাবগুলো আর চলতে পারছিল না। তখনই একটি দুষ্ট চক্র ক্লাবে ঢুকে পড়ে। তারা ক্লাবের ঘর ভাড়া নিয়ে ওয়ানটেন (ছোট তির ছুঁড়ে মারার খেলা) ও রামি (তাসের খেলা) নামের খেলা চালু করে। প্রতি রাতে ক্লাবগুলোকে এরা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিত।

যারা জুয়ার আসর বসাত, তারা রাজনৈতিক নেতা, মহল্লার মাস্তান ও পুলিশকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিত। ক্লাবপাড়ায় এই দুটি খেলার টাকা নিয়ে হাঙ্গামার ঘটনা বাড়তে থাকে। আরামবাগ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবে দুটি খুন হয়। এরপর ওয়ান-টেন খেলা বন্ধ করা হয়। মূলত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্লাবগুলো জুয়ার জন্য ঘর ভাড়া দিতে শুরু করে। প্রথম কয়েক বছর ওয়ান-টেন ও রামি চলতে থাকে। সাত-আট বছর আগে ক্লাবগুলো কলাবাগান ক্লাবের আদলে আন্তর্জাতিক মানের ক্যাসিনো চালুর উদ্যোগ নেয়।

কলাবাগান ক্লাবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে যায়। তবে সেখানে যাতায়াত ছিল এমন একটি সূত্র ইত্তেফাককে জানায়, কলাবাগানে স্লট মেশিন, জুয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের বোর্ড, নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী-পুরুষদের নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ক্লাবগুলোয় বাকারা (তাসের খেলা) নামের একটা খেলা হতো, পরে যুক্ত হয় রুলেট (চাকার মতো বোর্ড) এবং আরও কয়েকটি খেলা। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক নাজমুল করিম ওরফে টিঙ্কু। এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি, পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল।

নাজমুল করিম মারা যাওয়ার পর বিএনপির এক সময়ের ক্যাডার শফিকুল আলম ফিরোজ ও জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতা সেন্টু টাকাপয়সা হস্তগত করায় মহল্লার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে পুরো ক্যাসিনোসহ অসামাজিক কার্যকলাপ দুই নেতার হাতে চলে যায়। তার দৈনিক ক্লাবের আয় এক কোটি টাকা।

ফুটবল খেলোয়াড় ও ক্লাব সূত্র জানায়, কলাবাগান ক্লাবের আদলে প্রথমে ভিক্টোরিয়া ও পরে একে একে ওয়ান্ডারার্স, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, আরামবাগে স্লট মেশিন বসে। আগে হাউজির জন্য যেখানে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘর ভাড়া পেত ক্লাবগুলো, সেখানে প্রতি রাতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে। তাই খেলার বদলে জুয়া মুখ্য হয়ে উঠেছে।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা জানান, সরকারের এই উদ্যোগকে তাঁরা স্বাগত জানান। ১৮ সেপ্টেম্বর র?্যাবের অভিযানের খবর পেয়েই তিনি মোহামেডানের যে হলরুমে ক্যাসিনো ছিল, সেখান থেকে জুয়ার সরঞ্জাম বের করে তালা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক চাপের মুখে তিনি ঘর ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জানা গেছে, ক্লাবগুলো থেকে নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠকদের বিদায়ের কারণে বাংলাদেশে নতুন প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না।

প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে সেই কবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তা এখন আর সাদাকালো সমর্থকরা মনেও করতে পারেন না। ২০০২ সালে শেষ বার প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে কোটি টাকা পুরস্কার সুপার কাপ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এরপরও মোহামেডানের ফুটবল দলের অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। ২০০৬ সালে পেশাদার ফুটবল চালু হলে প্রথম তিন বারই মোহামেডান রানার আপ হয়। এরপর থেকে মোহামেডানের পারফরম্যান্স দিনে দিনে নিচেই নামতে থাকে।

ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব এক সময় দেশের অন্যতম ফুটবল ক্লাব ছিল এবং প্রথম বিভাগে খেলত। তাদের খেলা এখন পড়ে গেছে। এক সময় অনেক নতুন খেলোয়াড় তৈরি হতো, এখন খেলার রাস্তায় নেই ক্লাবটি। ওয়ান্ডারার্স পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ঢাকার ফুটবলে পরাশক্তি ছিল। শীর্ষ ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। বড় বড় অনেক ফুটবলার খেলতেন এই ক্লাবে। তবে অনেক বছর ধরেই ওয়ান্ডারার্স দেশের ফুটবলে আর আলোচনায় নেই। শীর্ষ লিগে তো নয়ই, পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরেও খেলে না। ওয়ারী দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ আগে অনেক খেলাই খেলত ক্লাবটি। ফুটবলে এই ক্লাব এখন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে খেলে। অথচ এক সময় ঢাকার ফুটবলে ‘ওয়ারী আইলো’ স্লোগান ছিল।

ভিক্টোরিয়ারও প্রায় একই অবস্থা। ক্লাবটি ক্রিকেটের প্রিমিয়ার লিগে খেললেও ফুটবলে শীর্ষ স্তরে নেই অনেক বছর। তারা এখন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে খেলে। কিন্তু তারা কোনো আলোচনায় নেই। হকিতে ক্লাবটি খেলে প্রিমিয়ার লিগে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তৈরি হওয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের মূল কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে জুয়ার আয়োজন করা।

সাবেক ক্রীড়া সচিব ও বর্তমান এমপি নুর মোহাম্মদ বলেন, বিশ্বের কোথাও কি এমন দেশ আছে, যেখানে খেলা ও খেলোয়াড়দের পৃষ্ঠপোষকতা করতে জুয়ার আয়োজন করা হয়! এটা ভীষণ লজ্জার। এই জুয়ার টাকার ভাগ সবাই মিলে মিশে খায়। খেলাধুলাকে বিদায় দিয়ে এই বেআইনি কাজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এজন্য খেলা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানকে তিনি সাধুবাদ জানান।

সৌজন্যে : দৈনিক ইত্তেফাক অনলাইন

শেয়ার করুন