করোনায় বন্দীজীবনে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ৮ কৌশল

সায়েমের বয়স চার। এ বছরই প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল সে। স্কুলে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় স্কুল। প্রতিদিন মাকে জিজ্ঞেস করে স্কুলে কবে যাবে? কেন বন্ধুদের সাথে দেখা হচ্ছেনা? খেলার মাঠেই বা যেতে পারেনা কেন আর? প্রথম কিছুদিন প্রশ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও ইদানীং আর কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছেনা ছোট্ট সায়েমকে। প্রচণ্ড খিটখিটে আচরণ এবং দৈনন্দিন কাজগুলো করতেও চরম অনীহা দেখা যাচ্ছে ওর মাঝে।

শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ইনার সার্কেল বিডি-তে কর্মরত বিহেভিয়ার থেরাপিস্ট সাদিয়া মুবাসশশারা জান্নাত এ বিষয়ে বলেন, যেকোনো মহামারী দুর্যোগ কিংবা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অন্যান্য বিষয়াদির সাথে সাথে বাড়ির শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য এবং অবস্থার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কারণ দুর্যোগ পরিস্থিতিতে শিশুদের মনোজগতে আসে বিশাল পরিবর্তন যার প্রভাব পরবর্তী জীবনেও রয়ে যেতে পারে।

করোনা পরিস্থিতিতে দেশে দেশে লকডাউনের প্রভাব ব্যক্তিজীবনে নানাভাবে পড়লেও এসব কিছুর মাঝে আমাদের শিশুরা রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। আর পরিণত হচ্ছে করোনার নীরব শিকারে। শিশুদের মনোজগতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে বলতে গিয়ে কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন সাদিয়া মুবাশশারা জান্নাত।

১. শিশুরা তাদের কমফোর্ট জোনের বাইরে যেতে পছন্দ করেনা। আর এই কারণে লকডাউনের ফলে কিংবা আর্থিক সংকটের জন্য পরিবারে তাদের প্রয়োজনমত বা পছন্দের খাদ্য সরবরাহ না হলে কিংবা কিছু না পেলে সেটি ভালভাবে নেয়না শিশু। তারা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দিন। কী কী পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে সে ব্যাপারে যতটা সম্ভব ওদের খুলে বলুন। তাতে আপনার পাশাপাশি শিশুরও মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।

২. সবার মুখে অথবা টেলিভিশনে শিশু করোনা নিয়ে অনেক ধরনের কথা শুনতে পায়। কিন্তু বাবা মাকে জিজ্ঞেস করলে যদি তারা সন্তোষজনক উত্তর না পায় বা অন্য কিছু শোনে তাহলে তারা ভাবে যে বাবা মা হয়ত তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেনা বা বলছেনা যে আসলেই কি হচ্ছে। এরকম চরম সংশয়ে থেকে সে বিভ্রান্ত বোধ করে। এজন্য ওদেরকে অবশ্যই ভুল তথ্য কিংবা অতিরঞ্জিত কোন তথ্য না দিয়ে যা সঠিক তাই বলুন। তার সাথে কথা বলুন এবং পরিস্থিতিতে শিশুর করনীয় সম্পর্কে বুঝিয়ে বলুন।

৩. ঘরের ভেতর সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে এ সময়টায় শিশুর শিখন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। স্কুলে যেতে না পারা এবং বাড়িতে অফুরন্ত অলস সময় পেয়ে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দুরে চলে যেতে পারে শিশু। যার প্রভাব দীর্ঘ সময় পর্যন্ত রয়ে যেতে পারে। তাই নিয়মিত শিশুদেরকে দিনের একটা সময় বইখাতা নিয়ে বসে পড়তে উৎসাহিত করুন।

৪. দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে বেরোতে না পেরে বা তার দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা আসাতে শিশুর আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে। মেজাজ দেখানো বা খিটখিটে আচরণ কিংবা খেতে না চাওয়ার মত জেদ করতে পারে সে। এজন্য শিশুকে নানা রকম সৃজনশীল কাজ এবং শারীরিক কসরত দরকার হয় এমন খেলায় ব্যস্ত রাখতে হবে। নিয়ম মেনে বাড়ির ছাদে বা সামনের রাস্তায় একটু হাঁটিয়েও নিয়ে আসা যায়।

৫. লকডাউনে দিনের পর দিন বাড়িতে থাকার কারণে এবং মানসিক ও অর্থনৈতিক কারণে অনেক অভিভাবক ঝগড়া করে থাকেন। এই ধরনের বিবাদ যদি সন্তানের সামনে হয় তাহলে তার প্রভাব খুব বড় রকমের হয় শিশুর ওপর। নিরাপত্তাহীনতা জেঁকে বসে এবং শিশুরা সে ধরনের আচরণ শিখেও যায়। সন্তানের জন্য আরামদায়ক এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করুন ঘরের ভেতর।

সাদিয়া মুবাশশারা জান্নাত, বিহেভিয়ারাল থেরাপিস্ট, ইনার সার্কেল বিডি।

৬. লকডাউনের ফলে পরিবারের ভেতর শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের হার বেড়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এই নির্যাতনের ট্রমা পরবর্তী জীবনে শিশুর বিকাশে বিরাট বাধা হয়ে আসতে পারে।

৭. এ সময়ে বাড়ির অন্য শিশুদের প্রতি বিরূপ আচরণও পরিলক্ষিত হয় শিশুদের মধ্যে। অনেক শিশুই মনে করে তার প্রাপ্য সময়টুকুও ভাই বা বোন নিয়ে নিচ্ছে। বাবা মাকে তাই খুব সতর্ক থেকে সব সন্তানকে সমানভাবে কোয়ালিটি সময় দিতে হবে। পরিবারের সবাই মিলে কিছু একটিভিটি যেমন বোর্ড গেইম, সিনেমা দেখা, দল বেঁধে গল্প করা বা ছাদে বেড়ানোও কাজে দেয় সম্পর্ক উন্নয়নে।

৮. যেসব বাবা মাদের বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করতে হচ্ছে সেসব বাসার ছেলেমেয়েদের সাথে তাদের বাবা-মার অনেক সময় দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বাবা মা বাড়িতে থেকে তাদের সময় দিচ্ছেনা এটা মেনে নেওয়া তাদের জন্য সহজ না। এ পরিস্থিতিতে তাদেরকে পড়ালেখা বা অন্য কাজের জন্য অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে তাদের সাথে কথা বলুন। ভালবাসুন। ওরা যে বাসায় থেকে নিয়ম মেনে চলছে সেইজন্য প্রশংসা করুন। এভাবে সম্পর্কের উন্নতি সাধন হতে পারে।

অন্যান্য সবার মত আপনার শিশুটিও লকডাউনে থেকে থেকে বিষণ্ণতায় ভুগতে পারে। এরকম সম্ভাবনাকে উড়িয়ে না দিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন। এরকম অস্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে তাদের মনোজগতে রীতিমত ঝড় বয়ে যাচ্ছে, হীনমন্যতা গ্রাস করছে। এরকম পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে আপনার সাহায্যই তাদের একান্ত কাম্য। ওদের আচরণে বিভ্রান্ত না হয়ে বরং কৌশলে সামাল দিন। সব রকম অনিশ্চয়তা, ভয়, উদ্বেগ কাটিয়ে উঠে এই দুঃসময় চলে যাবে- এমন সাহস দিন তাদেরকে।

শেয়ার করুন