ওসি মোয়াজ্জেম গ্রেফতার: ছিলেন পুলিশের আশ্রয়ে

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকান্ডে সহযোগিতার অভিযোগে আটক ওসি মোয়াজ্জেম। ছবি: সংগৃহীত

দেশব্যাপী আলোচিত ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ১৬ জুন রবিবার গ্রেপ্তারের আগের দিন পর্যন্ত তিনি কুমিল্লা জেলার এক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় ছিলেন। সেখান থেকে রবিবার ঢাকার উচ্চ আদালতে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর কাছে গিয়েছিলেন। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বেলা তিনটার দিকে শাহবাগ থানার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ওসি মোয়াজ্জেমকে খুঁজছিলেন ডিএমপি ডিবির একটি দল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকেই ডিবির দলটি রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালায়। পাশাপাশি ওসির বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় নজরদারি জোরদার করেন তারা। একই সঙ্গে ওসি মোয়াজ্জেমের দুটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগকারী ব্যক্তিদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়।

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এই অভিযোগ তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস সামছ জগলুল হোসেন। পরে পিবিআইয়ের দেওয়া প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গত ২৭ মে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশের গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য ওসি মোয়াজ্জেম যশোরের নিজ বাড়ি ও শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে রাজধানীর কল্যাণপুরে তার খালার বাসায় ওঠেন। গত ১০ জুন পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করছিলেন। এর মধ্যে গোয়েন্দারা সেই বাড়ির সন্ধান পাওয়ার পর ওসি মোয়াজ্জেম টের পেয়ে সেখান থেকেও সটকে পড়েন। সরাসরি চলে যান কুমিল্লা জেলার এক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে।

শাহবাগ থানার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লার একটি থানার ওই কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমের খালাতো ভাই। সেখানে অবস্থান করেই তিনি আগাম জামিনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ডিবির অনুসরণের বিষয়টি টের পেয়ে তিনি সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল বন্ধ করে রাখেন। এমনকি স্ত্রী ও স্বজনদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তবে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে আইনজীবী ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। এরই একপর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেওয়ার জন্য গতকাল সকাল ১০টার দিকে হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানা নামে একজন আইনজীবীর চেম্বারে যান।

মোয়াজ্জেমকে অনুসরণকারী ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মোয়াজ্জেম যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তাদের মোবাইল ফোনের অবস্থান অনুসরণ করে হাইকোর্ট এলাকায় তার অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হই। তারপর সেখানে গিয়ে একজন আইনজীবীর চেম্বারে আছে বলে জানতে পারি। তথ্যদাতা ওই আইনজীবীর নাম ঠিকমতো বলতে না পারার কারণে বিভিন্ন আইনজীবীর চেম্বারে খুঁজতে থাকি। এরই ফাঁকে আদালত থেকে আরেক মাধ্যমে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে খবর চলে যাওয়ায় সরাসরি অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানার রুমে গিয়ে ওসি মোয়াজ্জেমকে খুঁজে পায় তারা। সেখান থেকেই তাকে শাহবাগ থানা পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়।’

ডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, তথ্যদাতা সালমা না বলে সাহারা বলেছিলেন। এ কারণে সাহারার রুম খুঁজতে খুঁজতেই শাহবাগ থানা পুলিশের অপর একটি দল অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানার রুম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। যদিও গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে রমনা জোনের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর সুপ্রিম কোর্টসংলগ্ন কদম ফোয়ারা এলাকা থেকে মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, কুমিল্লার সদর এলাকায় মোয়াজ্জেমের নিজেরও একটি বাড়ি আছে। সেখানে অবস্থান না করে তিনি তার খালাতো ভাই পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। পুলিশ সেখানেও খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলে টের পেয়ে মোয়াজ্জেম গত শুক্রবার রাতে সেখান থেকেও চলে যান। এরপর কুমিল্লার সদর এলাকায়ই অন্য কারও বাসায় অবস্থান করেন। তারপর গতকাল ভোরে সেখান থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তারের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাফর ও খায়রুল ইসলাম মিনহাজ নামে দুজন ব্যক্তি। জাফর নিজেকে ওসি মোয়াজ্জেমের সাবেক গাড়িচালক ও খায়রুল ইসলাম মিনহাজ পূর্বপরিচিত হিসেবে দাবি করেন। তারা জানান, ওসি মোয়াজ্জেম আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে সকালে কুমিল্লা থেকে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। সেখানে অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানার চেম্বার থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানা বলেন, ‘ওসি মোয়াজ্জেমকে আমার রুম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তার সঙ্গে আমার দেখাও হয়নি। তবে গতকাল তার জামিনের বিষয়ে শুনানির চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আদালত আগামীকাল তার জামিন বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেছেন। এরই মধ্যে অন্য মাধ্যমে জানতে পেরেছি, তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন।’

শেয়ার করুন