বান্দরবানের চিম্বুক রেঞ্জের সুউচ্চ পাহাড়সারির একটা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটি ম্রো পাড়া। এর দু’দিকেই বাংলাদেশের খুব বড় দু’টি রেঞ্জের পাহাড়ের সারি, একদিকে মিরিঞ্জা রেঞ্জ আরেকদিকে মদক রেঞ্জ। পাড়াটি রেঞ্জের পাহাড়ের উপরে হওয়ায়, এখানে প্রায় সবসময়ই মেঘের আনাগোনা এবং বেশ ভালো বাতাস থাকে। আমরা পাড়ার যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি সেটাকে বাড়ি না বলে, একটা বন্যপ্রাণী জাদুঘর বলা যেতে পারে।
কতসব বন্যপ্রাণী ঘরের দেয়ালে ঝুলে আছে, একটাও ঠিক চিনি না। চুলার উপরে বাঁশের একটি মাচাং এর মত, সেখানেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বলা যেতে পারে আমরা যেমন মাছ থেকে শুটকি করি, তেমনভাবে বন্যপ্রাণীর শুটকি করে সংরক্ষণ করে হয়তো।
জুমগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বন্যপ্রাণী ধরার ফাঁদ। সারি সারি ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। যত দুর্গমে ঢুকছি, বন্যপ্রাণী ধরার ফাঁদের সংখ্যা মনে হয় বাড়ছে। এ পাড়ায় ফাঁদে একটা শজারু ধরা পড়েছে, পাড়ায় আনা হয়েছে। পাড়ার বাচ্চারা মৃত শজারুটার কাঁটা তুলছে। আরেকদিকে আগুন জ্বালানোর কাজ চলছে। আগুন জ্বালানো হয়েছে, শজারুটাকে পোড়ানো হচ্ছে।
বান্দরবানের গহীনে একসময় শিকারিদের সাথে অনেক জায়গা গিয়েছি, বিশেষ করে বান্দরবানের গহীনের সৌন্দর্য আমাকে দেখিয়েছে মূলতঃ শিকারিরা। নিজে কখনো বন্যপ্রাণী শিকার করি নি কিন্তু শিকার করা দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি – জেনেছি তাদের কাছ থেকে। শিশুগুলো তাকিয়ে আছে কখন এটি পোড়ানো শেষ হবে, কখন রান্না হবে, কখন এই শিশুগুলো খাদ্যতালিকায় একটু আমিষ যুক্ত হবে।
এই পাড়ায় আসার ঠিক দু’দিন আগে যে ম্রো পাড়ায় ছিলাম, তারা শিকার করে না। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে দেখি একটা পাখি ঘরের মধ্যে ঘুরঘুর করছে। পাখিটি মানুষ দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সকালে উঠে ইজোরে যখন দাঁত ব্রাশ করছি, পাখিটা আমার কাঁধে এসে বসলো। আমি দাঁত ব্রাশ করছি আর পাহাড়ের খাদে জমে থাকা মেঘ দেখছি, পাখিটাও কি আমার মত মেঘ দেখছে নাকি? কী নিশ্চিভাবে পাখিটা আমার কাঁধে বসে আছে, সে জানে তাকে এখানে কেউ মারবে না।
কয়েকবছর আগেও আমরা যখন পাহাড়ে যেতাম, প্রচুর বন্যপ্রাণী দেখতে পেতাম, দূর পাহাড়ে হেঁটে যাওয়া হরিণের পাল, বানর, ঈগল, সারস, ধনেশ আরও কত কিছু? এবার হয়তো একটু বেশি গভীরে গিয়েছি বলে হরিণের ডাক শুনতে পেয়েছি, বনমোরগ দেখেছি চোখের সামনে উড়ে যেতে, ঈগল পেয়েছি। খুব শীঘ্রই যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও হয়তো আর পাওয়া যাবে না।
দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন আছে, কিন্তু যেখানে দু’টো খাবার স্যালাইনের অভাবে ডায়রিয়ায় শিশু মারা যায়, গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে। যেখানে ম্যালেরিয়ায় মানুষ মারা যায় প্রতিনিয়ত। এক মৌসুম জুমে ফসল না হলে প্রায় না খেয়ে বছর কাটাতে হয়, সেখানে কিভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষনের কথা বলা যায় জানি না। এবারই তো, বেশিরভাগ পাড়ায় আমরা একটা মারফা পর্যন্ত পাই নি, এবার জুমে ফসল কম হয়েছে।
মানুষের যে কয়টি মৌলিক চাহিদা আছে রাষ্ট্র তার কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে? আমরা উন্নয়নের কথা বলি, পাহাড়িদের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলি না। আমরা শিক্ষার কথা বলি, পাহাড়ে শিক্ষার কথা বলি না, আমরা দেশ ভর্তি কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা বলি, টানা দশ দিন ২৬ টা পাড়া ঘুরে কমিউনিটি ক্লিনিক তো দূরের কথা, একটা প্যারাসিটামল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা শতভাগ স্যানিটেশন এর কথা বলি, দশদিন ঘুরে একটা পাড়ায়ও বাথরুম পেলাম না। দশদিনই চাঁদনী রাতে বদনা হাতে জংগলে গিয়েছি।
আমাদের উন্নয়নের গল্প আমাদের জন্য, পাহাড়িদের জন্য নয়। তারা এই দেশেরই নাগরিক কিন্তু রাষ্ট্র তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখেছে। এই লজ্জা কি আমাদের নয়? এই দেশের নয়? একদিন এই দেশের পাহাড় হারিয়ে যাবে, ঝিরি-ঝর্না হারিয়ে যাবে, আমার এই কথাগুলো গল্প হয়ে যাবে। পাহাড়ে যারা দীর্ঘদিন যাবত যান, আমি নিশ্চিত পরিবর্তনটা সবার চোখেই ধরা পড়বে। পাহাড়ে আর বন্যপ্রাণী থাকবে না, থাকবে কিভাবে? ক্ষুধার্ত বাচ্চাগুলোর শরীরে তো আমিষের প্রয়োজন আছে, কোনটি বেশি প্রয়োজনীয়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, নাকি এই শিশুগুলোর শরীরে একটুখানি আমিষ? আসলেই বুঝে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, বন্যপ্রাণী নয়, পাহাড়িদের পাহাড়ে টিকে থাকাই তো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই পাখিটির মত, প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি ঘরে, যদি সব পাখি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতো? যদি দুর্গমের কিছু পাহাড়ের মত পুরো পাহাড় জুড়ে এতো বড় বড় গাছ থাকতো? যদি প্রতিটি শিশুর, প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা যেতো? একটুখানি আমিষ পাওয়ার জন্য যদি আর কখনো কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা করা না হতো? আবার সবুজে অরণ্যে ভরে যেতো প্রিয় পাহাড়, আমাদের পাহাড়।। এই পাখিটার মতই সকল বন্যপ্রাণী নিশ্চিন্তে বসবাস করতো, পুরো পাহাড়জুড়ে, আহা!
রেজাউল করিম সুমন, পর্যটক।