‘সুন্দর’ ব্যাপারটা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে পৃথিবীর সাতশ কোটি মানুষ হয়তো সাতশ রকম উত্তর করবেন। তবে ভিন্ন ভিন্নভাবে বললেও একটি কমন জায়গায় এসে যতিচিহ্ন ফেলেন প্রায় সকলেই। তা হলো, ‘যা কিছু সত্য, শুদ্ধ ও সৎ তাই সুন্দর।’ এ ব্যাপারে ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক কবি জন কিটসের সেই অমর উক্তি, ‘Beauty is truth, truth is beauty.’
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন, বিশ্ব চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন বলেছিলেন, ‘Elegence is the only beauty that never fades.’ অর্থাৎ, ‘রুচিশীলতাই একমাত্র সৌন্দর্য যা কখনো বিবর্ণ হয় না।’ নিজে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়েও শরীরের মাপজোক কিংবা রঙকে তিনি সুন্দর বলেননি। হেপবার্ন ভালো করেই জানতেন, শরীরের সৌন্দর্য একটা মুহূর্তের বুদ্বুদ মাত্র। এই বুদ্বুদ দিয়ে সুন্দরকে বিচার করা রীতিমতো অন্যায়।
তবে কর্পোরেট দুনিয়ায় সুন্দরের সংজ্ঞা আলাদা। নারীর সৌন্দর্যের কথা আসলেই তারা ফিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের ভাষায় সুন্দর হলো ‘৩৬-২৪-৩৬’। সুন্দরী হিসেবে কে কত নম্বর পাবে সেটা নাকি তার শরীরের ভাঁজেই লেখা থাকে। কাঁচা বাজারের আলু-পটল কিংবা গরুর হাটের গরু কিনতে গিয়ে আমরা যেমন কোনো বাহ্যিক খুঁত রাখতে চাই না তেমনি সুন্দরী নির্বাচনেও শরীরের সামান্যতম এদিক-ওদিক হলে নির্বাচকরা তাকে ‘অসুন্দর’ বলে ঘোষণা করেন। মেয়েটির শরীরে হয়তো তারা ঠিক যা খুঁজছেন তা পাচ্ছেন না!
সুন্দরী প্রতিযোগিতা নামে এই ভ্রষ্টাচার বর্তমান দুনিয়ায় বেশ বাজার পেয়েছে। এটিই বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে অসুন্দর প্রতিযোগিতা অথচ নাম দেয়া হয়েছে সুন্দরী প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় নারীর কোমর, বুক ও নিতম্বের মাপ মেপে সুন্দরের ছাড়পত্র দেয়া হয়! আরও প্রাথমিক শর্ত হিসেবে শরীরের রং ফর্সা হতে হবে, সে কথাতো বলাই বাহুল্য। এভাবে একদিকে নিজেদেরকে আধুনিক দাবী করছি অন্যদিকে ঔপনিবেশিক মন নিয়ে এখনও শাদাকে সুন্দরচর্চার মিথ হিসেবে বহন করে চলেছি।
সুন্দরী প্রতিযোগিতা কি নারীর প্রগতি নাকি পণ্যায়ন? উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে কেউ কেউ বলছেন, ‘প্রগতি’! এর মাধ্যমে নারী নাকি শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে, অথচ বাইরে এসে আরও নোংরা শেকলে বন্দি হচ্ছে সে। এসব প্রতিযোগিতায় মেধার অংশটা আইওয়াশ মাত্র, বাকী সবটা জুড়েই থাকে গায়ের রঙ, বুকের প্রশস্ততা, কোমরের কুঞ্চন, নিতম্বের প্রসারতা! প্রথম মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার এমন মাপজোকের নম্বরপত্র এখন ফেসবুকে ভাইরাল। কী ভয়ানক নির্বোধ, একটি মেয়ে কত সহজেই তাকে অবমাননা করার সুযোগ একদল ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিচ্ছে!
বলা বাহুল্য, এই সুন্দরী সুন্দরী খেলার আসল কথাটা হলো বাণিজ্য। যখন এসব প্রতিযোগিতার নামও শোনা যায়নি তখন এই উপমহাদেশে সুন্দরী ছিলেন মীনা কুমারী, নার্গিস, বৈজয়ন্তীমালা, সুচিত্রা সেন, হেমা মালিনী, কবরী, ববিতারা। এই জমানায় যখন বাজার ও বিপণনের দরকার পড়লো তখন আসলো মিস অমুক-মিস তমুক। এই মিস সুন্দরীরা পণ্য হয়ে ছুটে বেড়ালেন এখান থেকে ওখানে। তারপর শারীরিক সৌন্দর্যের বুদ্বুদ শেষ হয়ে গেলে তাদেরকে ছুড়ে ফেলে দিলো কর্পোরেট দুনিয়া। তারা তখন ‘ডেট এক্সপায়ার’!
লাক্স কোম্পানি কখনো সুন্দর হয়ে ওঠার সাবান বিক্রি করে না। তারা বিক্রি করে দীপিকা পাড়ুকোন, ঐশ্বরিয়া রায়, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ক্যাটরিনা কাইফ কিংবা আমাদের দেশের মম-মেহজাবিনকে। আপনি ওদের দেখে লাক্স সাবান কেনেন, সাবান মাখলে আপনি দেখতে ওদের মতো হবেন এই ভ্রমে। এই ভ্রমকে টিকিয়ে রেখে ব্যবসা করার জন্য কর্পোরেট দুনিয়ার চাই নতুন নতুন দীপিকা। ঐ নতুন দীপিকার শরীরকে সেক্স অবজেক্ট তথা যৌন কাঁচামাল বানিয়ে তাদের পণ্যটি তারা গছিয়ে দেবে ক্রেতার হাতে।
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার জনৈক বিচারক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী এক সুন্দরীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমার মধ্যে যৌবনের ভারি অভাব’। আর মেয়েটি তাতে খুব মন খারাপ করলো! নিজেকে আরও যৌবনা করে পুরুষের চোখে সুশোভিত হয়ে ধরা দিতে চায় সে। না হয় সে হেরে যাবে।
যে নারী নিজে বিশ্বাস করে, তার মূল্য তার শরীরে, মূল্য তার শরীরের কুঞ্চনে, বন্ধুরতায়!’ বাইরে থেকে আমরা কিভাবে আশা করতে পারি, আরেকজন তাকে সম্মান করবে? তাকে দেখলে পুরুষের চোখ কি বিনয়ে নুয়ে পড়বে নাকি কিছু খুঁজে বেড়াবে? এ প্রশ্নে নারীর কোনো তর্ক দেখি না।
জানি, পুঁজিবাদের কথা বলবেন তো? ভালো কথা, পুঁজিবাদ যখন বুঝাতে চায়, নারী, তোমার শরীর তোমার জন্য পুঁজি। তখন নারী সেটা মেনে নেবে কেন? ফেয়ার এন্ড লাভলী যখন বলে, শাদাই তোমার শক্তি, তখন আপনার সেটা মেনে নিতে হবে কেন? কই, কালো কুচকুচে আর অসুন্দর (আমাদের প্রচলিত ধারনায়) অপরাহ উইনফ্রের জন্য পৃথিবীর সেরা সেলিব্রেটি হওয়ার ক্ষেত্রে তার শরীরতো কোনো বাধা হয়নি।
আমাদের দেশেও তার উদাহরণ কম নয়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বিজয় করে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন যে দুই নারী, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর মতে তাদের কোনো শক্তি নাই! ১৯ শতকে নারী বন্দী ছিল রান্না ঘরে আর এখন নারী বন্দি পণ্যের খাঁচায়। নারীর মধ্যে রান্না ঘর থেকে বেরোনোর যতটা তাগাদা আছে তার কিয়দাংশও যদি এই কর্পোরেট খাঁচা থেকে বেরোনোর তাগাদা থাকতো তাহলে নারীর সম্মান আরো বাড়তো বৈ কমতো না।
মিস ওয়ার্ল্ড নামক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিবাহিত নারী অংশ নিতে পারেন না। কেন? তার মানে বিবাহিত নারী সুন্দরী নন? নাকি এটি মিসদের অর্থাৎ অবিবাহিতদের প্রতিযোগিতা বলে? তাহলেতো আরও সমস্যা, ডিভোর্সি মেয়েটি কি করবে? মেয়েটিতো এখন আর বিবাহিতা নন। কিংবা যে লিভ টুগেদার করে সে কী করবে? কিংবা যে মেয়েটি ধর্ষিতা সে কী করবে? আসলে সমস্যাটা কি মেয়েটির বিয়েতে নাকি কুমারীত্বহীনতায়?
ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ঢাকতে চেষ্টা করা আসল কথাটা হলো, কর্পোরেট দুনিয়া বিশ্বাস করে বিয়ে, ডিভোর্স বা সন্তান ধারণ নারীকে ‘অসুন্দর’ করে ফেলে। এগুলো নারীকে এতটাই কুৎসিত করে ফেলে যে সে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রণের যোগ্যতাও হারায়। হায় সুন্দরী প্রতিযোগিতা, নারী যদি জানতো, তাকে অসম্মান করার এর চেয়ে বড় কোন প্রতিযোগিতা আর হয় না!
কথাটা আরও পরিস্কার করে এভাবে বলা যায়, তুমি অযোগ্য, অসুন্দর কারণ তুমি ‘ব্যবহৃত’, ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’!
এখন আর কেউ নবাব ফয়জুন্নেসা কিংবা বেগম রোকেয়া হতে চায় না। তার চেয়ে নিজেকে অপমান আর অসম্মান করার এই স্টেজে উঠতে কত হুড়োহুড়ি। নিজেকে অন্যের চোখে পণ্য করে সে নাকি সাহসী হচ্ছে! ওদিকে নারীকে ‘আইটেম’ হিসেবে কল্পনা করা পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ায় প্লাস্টিকের সেক্স টয়ে আর পোষাচ্ছে না তাই এবার তাদের প্রয়োজন রক্ত মাংসের সেক্স টয়। এমন প্রতিযোগীতার মাধ্যমে বছরান্তে তারা সেসব যোগান দিচ্ছে।
কীসে নারীর মান আর কীসে অপমান, এটা নারীকেই আগে বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে। আইটেম সং-এ আইটেমটা নারী নিজেই এটা যদি ঐ নারী না বুঝে, না অনুধাবন করে তাহলে পাশ থেকে হাজারবার বুঝিয়েও কোনো লাভ নেই।
জানি, কিছুই বদলাবে না, কেউই বুঝবে না, অনুধাবন করবে না। পুঁজিবাদের শক্তি বোধহয় এটাই যে, সে বোধকে ভোঁতা করে দিতে পারে। এভাবে কিছু মেয়ে নারী স্বাধীনতার নামে, সাহসিকতার নামে কাপড় খুলবে, আর তা দেখে কিছু মানুষ মেয়েদের পড়াশোনাই বন্ধ করে দিতে চাইবে।