ভিসি স্যারের ভাইরাল ক্লিপ এবং আমাদের বর্ণবাদী মন

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চা সিঙ্গারা সমুচার দাম প্রসঙ্গে কথা বলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি এখন আলোচনার শীর্ষে।

ঢাবির ভিসি স্যারের ‘১০ টাকায় চা সিঙাড়া, চপ সমুচা’র ক্লিপটা ভাইরাল হইছে। আমার ধারণা আগামী দিনগুলিতে এইরকম আরও কিছু ভাইরাল ক্লিপ উনার কাছ থেকে পাওয়া যাবে।

এমনিতে নানা প্রতিষ্ঠানের কর্তা-কর্তৃরা নানান সময়ে নানান রকম সার্কাস তো দেখানই। এ আর নতুন কি! ও.কা. এবং রু. ক. রিজভীর মধ্যে যেমন এই ব্যাপারে চলতেছে দীর্ঘদিনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।

ঢাবির বর্তমান ভিসির লেভেলের কথা আগের ভিসিগণ বা অন্যান্য পদস্থগণ বহুবার বলছেন। সেইগুলা ভাইরাল হয় নাই।

তবু ১০ টাকায় চা, সিঙ্গারা চপ, সমুচার ক্লিপটা ভাইরাল হওয়ার নির্দিষ্ট কারণ আছে।

আমার ধারণা এই নির্দিষ্ট কারণটা তার কমিক ডেলিভারি।

মোশাররফ করিমের নাটকের কারণে হোক আর যে কারণেই হোক, অলরেডি বরিশাইল্যা একসেন্ট দেশের মানুষের কাছে ফানি বলে পারসিভ হওয়া শুরু করছে। ভবিষ্যতে এইটা আরও বাড়বে হয়তো।

উনার উচ্চারণ যদি সো-কল্ড ‘প্রমিত’ হইতো এমন ভাইরাল হইতো কী?

আমার মনে হয় না।

ক্লিপের চা, সিঙাড়া, সমুচা, বা চপ এর উচ্চারণে যথেষ্ট ‘প্রমিত’ হয় নাই বলেই অনেকের কাছে ফানি মনে হইতেছে। তার উপ্রে বরিশাইল্ল্যা টোনে বলাটাই কমিক।

তারটা আরও বেশি কমিক কারণ পিওর বরিশালের একসেন্ট যতটা ফানি তার চাইতে বরিশাইল্যা একসেন্টে অভ্যস্ত কারও ‘প্রমিত’ বা ‘শুদ্ধ’ ভাষায় বলতে গিয়া ফেইল করাটা আরও বেশি ফানি বলে পারসিভড হয়।

আসেন, একই কথার তিনটা ভার্সন পড়ি।

ভার্সন-১:
কী বলছো তুমি? তাহলে তো সমস্যা হয়ে যাবে।

ভার্সন-২:
তুমি কইতে আছো কী ? হেলে তো সমেস্যা ওইবে।

ভার্সন-৩:
তুমি, কী বলতে আছো? তা হইলে তো সমেস্যা হইয়া যাইবেআনে।

এই তিনটা ভার্সনের মধ্যে তুলনায় কোনটা বেশি ফানি?

ভার্সন ৩-রে বেশিরভাগ বাংলাদেশি বেশি ফানি হিসেবে পারসিভ করবে।

কারণ?

ভার্সন-থ্রি টা ‘প্রমিত’ বা বরিশাইল্যা কোনটাই না। ওইটা বরং বরিশাইল্যা কারও ‘শুদ্ধ’ ভাষায় বলতে গিয়া নিদারুণ ব্যর্থ হওয়ার নমুনা, যা ফানি লাগে। অনেকটা কলার খোসায় পা পিছলায়ে পড়ে যাওয়ার মতোই।

এই ধরণের কমেডির নজির বাংলা কমেডিতেই আছে।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (আসল নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ) নামে একজন তুমুল জনপ্রিয় কমেডিয়ান ছিলেন। ভানু মারা গেছেন আমার জন্মেরও অনেক বছর আগে। তো, হিউমারে তথা কমেডিতে, আমার আগ্রহের কারণে ইন্টারনেটে তারে পেয়ে গেছি।

‘প্রমিত’/ ‘শুদ্ধ’ বলতে গিয়া নিদারুণ ব্যর্থ ও পর্যুদস্ত ভানু যে ফানি হয়ে ওঠেন তা মূলত ‘প্রমিত’ বাংলার প্রেক্ষিত/পটভুমিতেই কেবল সম্ভব।

অর্থাৎ মনে মনে একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ধরে সেইখান থেকে বিচ্যুতির উপ্রে বেইজ করে ফানি লাগা। যেমন, ‘আপনি’র চাইতে মেবি ‘আপনে’ ফানি লাগতে পারে।

ধরা যাক, ভানুর সেই জোকটা, যেখানে মা কলকাতায় যাওয়ার আগে ভানুরে হ দেখামাত্র শ দিয়ে রিপ্লেস করতে শিখায়ে দিছেন। যেমনঃ হালা (শালা), হারাদিন (সারাদিন)।

তো, ভানু কলকাতায় একদিন এক বাড়িতে বলে বসলো ‘শারমোনিয়াম’।

ঢাবির ভিসির ভাইরাল ক্লিপটা মূলত ভার্সন-৩ -এরই একরকম প্রকাশ।

[বিঃদ্রঃ আপনি সতর্ক পাঠক হইলে হয়তো খেয়াল করছেন ‘প্রমিত’ বা ‘শুদ্ধ’ শব্দগুলিরে আমি উর্ধ্বকমার মধ্যে ঢুকায়ে দিছি।]

কোনো ভাষাই অন্য কোনো ভাষা থেকে মন্দ, অসুন্দর বা দূর্বল হয় না। নিরক্ষর মানুষের ভাষাও শুদ্ধ। ‘ভাষা’ আর ‘অশুদ্ধ’ এই শব্দ দুইটা পাশাপাশি যায় না। প্রত্যেকটা ডায়ালেক্ট , এমনকি টিনস্পিকও সিস্টেমেটিক। যেকোনো ভাষাই শুদ্ধ।

(শেষের বাক্যটা আপনার কাছে অদ্ভুত ঠেকতে পারে। এইখানে আপনারে নানান আর্গুমেন্টে কনভিন্স করতে পারতাম। পরে সময় পাইলে করবো। )

তবু নানান রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে জনগোষ্ঠীর পারসেপশনে একটা ভাষা আরেকটার চাইতে সুন্দর, অসুন্দর কিংবা স্মার্ট, ক্ষ্যাত লাগে।

এক অঞ্চলের বুলি আরেক অঞ্চলের বুলির উপ্রে হেজিমনিক বা প্রভুত্বকারী হয়া ওঠে। বাংলায় যেমন এক ‘প্রমিত’ সমস্ত ডায়ালেক্ট, এমনকি স্থানিক উচ্চারণগুলির উপ্রে প্রভুত্বকারী হয়া উঠছে।

আপনি ভিসি স্যারের বক্তব্য নিয়া মজা করেন। আমার তরফে নো আপত্তি। এই রকম বক্তব্য ভিসিসহ আরও নানান কর্তা ব্যক্তিরা অহরহ দিতে থাকেন। তাদের কন্টেন্টই ইনাফ ফানি।

কিন্তু ভিসি স্যারের উচ্চারণই যদি আপনার বিনোদনের উৎস হয়, ওইটা আপনার রেসিস্ট, ঔপনিবেশিক মন। ভাষাবর্ণবাদী মন ওইটা।

গায়ের রঙ সাদা ব্যতিত কালো, বাদামি, হলদে বা যেকোনো চামড়ারে অসুন্দর ভাবতে পারা মন ওইটা। এই মনের মেরামত দরকার। কারণ এই মন পুষ্টির অভাবে যথেষ্ট বিকশিত হয় নাই।

আপনার বাবা বা দাদার মুখের ভাষা ভালো করে শুনে দেখতে পারেন। যে যে অঞ্চলের লোক তার কথায় সেই অঞ্চলের টোন থাকাই স্বাভাবিক। উনি ভিসি বলে উচ্চারণের কোর্স করে ‘প্রমিত’ বলতে হবে এমন কুসংস্কার নিয়া থাইকেন না।

দুনিয়াতে এমনিতেই প্রচুর কমেডি আছে উপভোগের জন্যে৷ বিনোদনের জন্যে সংকীর্ণমনা ও বর্ণবাদী না হইলেও চলে।

-কেএমএ রাকিব

শেয়ার করুন