ভারতে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় তিন সপ্তাহের নজিরবিহীন লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর সে দেশের ভিন্ন রাজ্য থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরা অনেকেই রুটিরুজি হারিয়ে নিজের গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন।
লকডাউনে তাদের কাজকর্ম থেমে গেছে, এর মধ্যে ট্রেন ও বাস আচমকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা অনেকেই শত শত মাইল পথ পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিতে শুরু করেছেন। দিল্লি থেকে অনেকেই তারা রওনা দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানের দিকে, আবার গুজরাট থেকেও কেউ কেউ টানা দুদিন বা তিনদিন একনাগাড়ে হেঁটে ফিরে আসছেন রাজস্থানে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, অনেক মহাসড়কে এখন গাঁটি-বোচকা, ব্যাগ-সুটকেস মাথায় দল ধরে ধরে বহু মানুষকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকার এই অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করলেও তারা কেউই সরকারি সাহায্যের ভরসায় অপেক্ষা করতে পারেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার লকডাউন ঘোষণার ভাষণে বলেছিলেন, “দেশবাসীর এখন আগামী কয়েকদিন একটাই কাজ – নিজেদের ঘরের ভেতর আটকে থাকা।” কিন্তু যারা রুটিরুজির ধান্দায় নিজের ঘর ছেড়ে বহু দূরে ছোটখাটো কাজ করছিলেন তারাই এতে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন – কারণ তাদের ঘরে ফেরার ট্রেন, বাস সবই বন্ধ।
রাজস্থানের ঢোলপুরের বাসিন্দা কিষেণলাল দিল্লির একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন। দোকান বন্ধ থাকায় তার মাইনেও জুটছে না, কাজেই তিনি কয়েকশো মাইল দূরের ঢোলপুরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। তিনি বলছিলেন, “রাস্তায় কোনও ট্রাক বা গাড়ি কিছুটা রাস্তা বসিয়ে নিলে ভাল, নয়তো হেঁটেই গোটা রাস্তা মেরে দেব।”এই যাত্রায় তার সঙ্গী রাকেশ জানান, “এখানে বসে থাকলে কেউ তো আর মাইনে দেবে না – দেখি গাঁয়ে গিয়ে কিছু কাজ পাই কি না। অন্তত ক্ষেতে গম তো কাটতে পারব।”
রাজস্থানের সুরথগড়ের একটি কোল্ডস্টোরেজে কাজ করতে বিহারের চম্পারণের জনা পঞ্চাশেক কর্মী। কাজ হারিয়ে এই গোটা দলটি আবার প্রায় বারোশা মাইল দূরে তাদের গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন – যদিও দুদিনে তারা পৌঁছেছেন সবে আগ্রা পর্যন্ত। প্রচন্ড গরমে, ক্ষিদেয় আর পিপাসায় এর মধ্যেই তাদের দশা রীতিমতো কাহিল। ওদিকে দিল্লি থেকে দুতিনশো মাইলের মধ্যে যাদের গ্রাম, তারা রাস্তায় নেমে পড়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবছেনই না।
কোলের বাচ্চা-সমেত পাঁচ জনের একটি পরিবার যাচ্ছিল দিল্লি থেকে আলিগড়। রীতিমতো ধুঁকতে ধুঁকতেও জাতীয় সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে পরিবারের বউটি বলছিল, “পৌঁছে আমরা নিশ্চয় যাব – হ্যাঁ, সময় লাগবে, কষ্টও হবে, দুটো পুরো দিন হয়তো লেগে যাবে। তারপরও শনিবার ভোরের দিকে গাঁয়ে চলে যেতে পারব বলে আশা করছি।” তার জা আবার পাশ থেকে যোগ করেন, “দিল্লিতে যার পকেটে পয়সা নেই, সে কী খাবে বলুন তো? পেটে কি কিল মেরে থাকবে? গ্রামে গেলে অন্তত রুটি আর চাটনি তো আশা করি পাব।” তার স্বামীরও আক্ষেপ, “এভাবে পথে নেমে পড়া ছাড়া কোনও উপায় নেই, কারণ দিল্লি শহরে কেউ কাউকে দেখে না।”
লকডাউন জারি হওয়ার পর থেকেই বিশাল দেশ ভারতের নানা প্রান্তে শুরু হয়েছে গ্রেট মাইগ্রেশন। শত শত অভুক্ত, গরিব মানুষের মাইলের পর মাইল পথচলার করুণ মিছিল।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করেছেন, এই শ্রমিকদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করতে সরকার বিশাল অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে আসছে। সীতারামন জানান, “এই অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ও শহর ও গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষের জন্য আমরা মোট ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি রুপির সহায়তা প্যাকেজ দেব।” “তাদের অ্যাকাউন্টে যেমন নগদ ট্রান্সফার করা হবে, তেমনি তাদের খাদ্য নিরাপত্তার দিকটাও দেখা হবে – সরকার চায় না এদেশে কেউ ক্ষুধার্ত থাকুক।”
কিন্তু সরকারের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যতটা সময় লাগবে, ভারতের কোটি কোটি গরিব শ্রমজীবী মানুষের অভুক্ত পেট ততক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারছে না সেটা দেখাই যাচ্ছে। আর এ কারণেই মরিয়া হয়ে তারা নেমে পড়েছেন রাজস্থান থেকে বিহার, কিংবা পাঞ্জাব থেকে উত্তরপ্রদেশের পথে সুদীর্ঘ পদযাত্রায়!