প্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ফেইসবুকভিত্তিক ব্যবসা বা এফ-কমার্স। ছোট, মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দেশের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানও এখন ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। তাদের একেকজনের রয়েছে একেক ধরনের বিক্রয় নীতি। এর মধ্যে পণ্যের ছবির সাথে দাম উল্লেখ করা বা না-করা নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কোনো কোনো বিক্রেতা পণ্যের বিজ্ঞাপনের সাথেই সেটির মূল্য ঘোষণা করেন, কেউবা আবার কমেন্টে দাম জানতে চাইলে সম্ভাব্য ক্রেতাকে ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে দাম জেনে নিতে বলেন।
এভাবে পণ্যের ছবি বা ঘোষণার সাথে দাম উল্লেখ না করার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। এটি তেমনই একটি আলোচনা। (পাঠকের সুবিধার্থে এখানে বিভিন্ন ইংরেজি শব্দ সচেতনভাবেই বাংলায় অনুবাদ করা হয়নি)
ফেইসবুকভিত্তিক যারা ব্যবসা করেন তাদের বেশিরভাগই রিসেলার বা সার্ভিস প্রোভাইডার। এখানে খুব অল্প সংখ্যক আছেন যারা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন। যারা অন্য কোন সোর্স থেকে পণ্য সংগ্রহ করে বিক্রি করেন অর্থাৎ যারা রিসেলার তারা সবসময় একই পণ্য একই পরিমাণে একই মূল্যে কিনতে পারেন না।
ধরুন একজন সেলার কোন এক সোর্স থেকে জুতা কালেক্ট করে অনলাইনে সেল করেন। উনি আজ সেল শুরু করেছেন অল্প কোয়ান্টিটিতে; ১০ পিস জুতা কিনলেন ১০০ টাকা করে ১০০০ টাকায়। উনি ডিসিশান নিলেন উনি ২০০ টাকা করে এই জুতা সেল করবেন। উনি পোস্টে ২০০ টাকা প্রাইস দিয়ে পোস্ট করলেন। এই জুতাগুলো সেল করে ভালো রেসপন্স পেলেন। পরবর্তীতে উনি ১০ পিসের জায়গায় যখন ৫০ পিস জুতা কিনবেন তখন উনি প্রতি পিস কিনলেন ৮০ টাকা করে। এখন উনি চাইলেন অতিরিক্ত প্রফিট না করে প্রফিট রেশিও সেইম রাখবেন অর্থাৎ ১০০% প্রফিট করবেন। তখন উনি সেল করবেন ১৬০ টাকা। এখন উনি যেহেতু আগে ২০০ করে পোস্ট দিয়েছেন এবং বর্তমানে উনার কস্ট-প্রাইস কম হওয়ার কারণে উনি কমে সেল করতে চাচ্ছেন এটা কি অপরাধ হবে? উনি যদি এখন সেইম মডেলের সেইম জুতা যেটা আগের পোস্টে ২০০ টাকা সেল করেছেন সেটা ১৬০ টাকা দাম পোস্ট করেন তবে সেটা কন্ট্রোভার্সি (বিতর্ক/বিবাদ) তৈরি করবে যেটা পোস্টে ব্যাখ্যা করা যায় না বা ব্যাখা করাটা অপ্রয়োজনীয়।
এবার আসুন উলটো দিকে। আগে আমি যেই প্রোডাক্ট ১০০ টাকায় কিনলাম সেটা পরেরবার প্রাইস বেড়ে যেতে পারে। আমি প্রফিট কম করলাম ২-৩ বার সেল প্রাইস সেইম রেখে। কিন্তু এক সময় কস্ট-প্রাইস বেড়ে যাওয়ার কারণে সেল প্রাইস ও বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। এখন আগের পোস্টে যদি দেখা যায় একটা প্রোডাক্ট ১ বছর আগে ১০০ টাকায় সেল হয়েছিল। সেইম প্রোডাক্ট ১ বছর পরে সেলার ২০০ টাকা চাচ্ছেন সেটা তখন পেইজে আবারো ঝামেলা তৈরি করবে। ক্রেতা কিন্তু ১ বছরে কী কী পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে বা টাকার মুল্য কতটুকু কমেছে এটা হঠাৎ করেই চিন্তা করতে পারবেন না।
প্রশ্ন থাকতে পারে যে, প্রাইস ভ্যারিয়েশন কেন হবে। আগেই বললাম ফেইসবুকে বেশিরভাগ (সবাই না) সেলারই রিসেলার বা স্মল স্কেলে সেল করেন। তারা প্রোডাকশন করেন না বা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন না। মোতালেব প্লাজা, গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, চকবাজার থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড, চায়না, ইন্ডিয়া বিভিন্ন সোর্স থেকে বিভিন্ন ভাবে প্রোডাক্ট কালেক্ট করেন। একই প্রোডাক্ট অনেকেই কালেক্ট করেন। এক এক জনের সোর্সিং এক এক রকম হওয়ার কারণে প্রাইসেই তারতম্য থাকে। একজন যেটা ১০০ তে কিনলেন সেটা অন্যজন ১৩০ এ কিনতে পারেন। তাদের সেল প্রাইসেও তারতম্য হবে। তাই প্রাইস নির্ধারণ করাটা তাদের হাতে থাকেনা সবসময়। আজ যে মোবাইল ফোন রিলিজ হল সেটার আজকের প্রাইস আর ৬ মাস পরের প্রাইস কখনো সেইম হবে না। সপ্তাহে ৬ দিন অফিস আওয়ারে রিক্সা ভাড়া যা হবে সেটা আর শুক্রবার ভোর ৬ টা বাজে সেইম ডিস্টেন্সে রিক্সা ভাড়া সেইম হবে না। আজকে এক ডজন ডিম কত আর এক সপ্তাহ পরে কত হবে বা আগে কত ছিল যারা বাজার করেন তারা জানেন। তবে কি এই ভ্যারিয়েশন প্রতারণা হবে? আলিবাবা অ্যামাজন আজ যে প্রাইসে প্রোডাক্ট সেল করছে ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে সেই প্রাইসে সেল করবে না। সকল প্রকৃত ক্রেতাগণ এই ব্যাপারে অবগত থেকেই প্রোডাক্ট কেনেন। তাই প্রাইস ভ্যারিয়েশন যদি প্রতারণা হয় তবে আমরা সবাই কম বেশি প্রতারক।
ফিজিক্যাল স্টোরে এক বছর আগে একটা প্রোডাক্ট কত মুল্যে সেল হয়েছে সেটা দেখার কোন ওয়ে নাই। কিন্তু অনলাইনে ৫ বছর আগে কী প্রোডাক্ট ছিল কত প্রাইস ছিল সব কিছুই দেখা যায়। তাই প্রাইস ওপেন রাখাটা অনেক সময়, আবারো বলি অনেক সময় (সব সময় না) আননেসেসারি কন্ট্রোভার্সি (অপ্রয়োজনীয় বিবাদ) সৃষ্টি করতে পারে যেটা একজন নতুন বা স্মল স্কেলের সেলারের পক্ষে সামাল দেয়া কঠিন হতে পারে বা প্রায় অসম্ভব হতে পারে।
পরিশেষে, যারা প্রকৃত অর্থেই আগ্রহী ক্রেতা তারা কখনোই ব্যক্তিগতভাবে প্রাইস জিজ্ঞেস করায় সংকোচ করেন না বরং প্রয়োজন মনে করেন। কারণ, এতে করে শুধু প্রাইস না; কখন ডেলিভারি হবে, ডেলিভারী পদ্ধতি কী হবে, প্রোডাক্টের ম্যাটেরিয়াল কী কোয়ালিটি, কেমন এবং সবশেষে একই বসায় অর্ডার প্লেস করে তার ডিলটা ক্লোজ করতে পারেন। যেটা কমেন্টে করাটা সময়সাপেক্ষ এবং কাষ্টমারের প্রাইভেসির জন্যও ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
ইনবক্সে প্রাইস বলা মানে প্রতারণা- এটা একটা ভিত্তিহীন জেনারালাইজড ষ্টেটমেন্ট এবং নেগেটিভিটি ছড়ায়। যেটা আশা করি আমরা কেউই চাই না।
এই লেখাটি সম্পর্কে আপনার কোনো মতামত থাকলে তা আমাদের ই-মেইলে পাঠাতে পারেন। লেখা মানসম্মত হলে আমরা সেটিও প্রকাশ করার চেষ্টা করবো। ই-মেইল: kholachokhmedia@gmail.com