ছেলেবেলায় গ্রামে শুকর হত্যার দৃশ্য দেখতে কখনো যাইনি। শুনতে পেতাম দূর থেকে। এমনকি দূর গ্রাম থেকেও শুকর হত্যার বীভৎস চিৎকার ভেসে আসতো। শুকর হত্যা চলতো সাপ্তাহিক বাজারের দিনকে কেন্দ্র করে। মূলতঃ বাজারের দিনেই সকাল সকাল হত্যা করা হতো।
পাহাড়িদের খাদ্য তালিকায় শুকরের মাংস সবার উপরে। অন্যদিকে বকা দিতে, রাগ দেখাতে ‘শুকর’ শব্দটির ব্যবহারও বহুল প্রচলিত। যে কোন উৎসবে শুকরের মাংস থাকা চাই। যা না পেলে বদনাম চলে। সাপ্তাহিক বাজারের দিনে সকলের চেষ্টা থাকে কোন না কোনভাবে কমবেশি শুকরের মাংস কেনার ।
বাড়িতে মায়ের পছন্দ মাছ হলেও বাবার প্রিয় শুকরের মাংস। প্রতি সপ্তাহে এক পোয়া মাংস কিংবা একটি পা কিনবেনই কিনবেন। শুকরের মাংস আর নাপ্পি বেচাকেনার জন্য আলাদা একটি বাজার ছাউনি থাকে প্রায় সব বাজারে। বাজারের দিনে একজন পাহাড়ি শুকর মাংস কিনতে পারুক বা না পারুক কয়টি শুকর বাজারে এলো, কী দর উঠলো জানার জন্য হলেও সে ছাউনিতে যায়।
২০০১-২০০২ সালের দিকে, এনজিওতে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ শুকরের মাংস খাওয়ার রুচি কমে যায়। এখনো সে ধারা অব্যাহত আছে। মধ্যে দুই-একবার খেয়েছি অ্যাডিলেড-এ। বান্দরবানে থাকাকালীন আমার প্রায়ই ম্যালেরিয়া লেগে থাকতো, টাইফয়েডও হতো। ম্যালেরিয়া আর টাইফয়েড নিয়ে ডা. অংসুই দা’র চেম্বারে অনেকবার গিয়েছি। তিনি বড়ভাই উহ্লা মংকে চিনতেন বলে ফি নিতেন না। তাঁকে গ্রাম পর্যায়ে ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দিবস’ উদযাপন করতে অতিথি করে বাঘমারা পাড়ায় একদিন নিয়েও গিয়েছিলাম বলে মনে আছে। সেটি অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ, তবে সেই সময়ে অনেকের মুখে শুনতাম ‘শুকরের মাংস খেলে ম্যালেরিয়া যায় না’। কতটুকু সত্যি জানি না। আমার এ মাংস খাওয়া কমে যাওয়ার পিছনে শোনা কথাটির প্রভাবও থাকতে পারে।
আমাদের ছেলেবেলায় খাগড়াছড়িতে স্থানীয় ছোট প্রজাতির শুকরই দেখেছি। এখন হাইব্রিড বড় প্রজাতির শুকরে গ্রাম, বাজার ভরে গেছে। পাহাড়ে গেলে অনেককে বলতে শুনি “শুঅর এড়া মজা নেই, বানা তেল”। বান্দরবানে কাজ করতে গিয়ে প্রথম বড়, লম্বা প্রজাতির শুকর দেখেছি। ২০০১-২০০২ সালে রোয়াংছড়ি বাজারের মাঝখানে দলবেঁধে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। কেননা এত বড় শুকর জীবনে কোথাও দেখিনি এবং এ নিয়ে তখন পর্যন্ত কোন ধারণা ছিল না। মনে আছে, সে বার নুহাই আর হাই নু (নামের বানান ভুল হয়ে থাকতে পারে) দের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলাম। সেখানে শুধু হরিণের মাংসেরই কয়েক পদের রান্না খেয়েছিলাম। ২০০২-২০০৩ সালে বান্দরবান জেলা সদরে কিছু এলাকায় শুকরের পায়খানার জন্য যাওয়া যেতো না। সেই অভাবের দিনেও আমি প্রায় সময়ে রিকশাতে করে এসব জায়গায় যাতায়াত করতাম। এখন কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে জানি না। তবে সদরের পাড়াগুলো দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারি। পাড়াগুলো সংকুচিত হওয়ায় শুকরের সংখ্যাও এতদিনে কিছুটা কমে যাওয়ার কথা।
পাহাড়ের এ মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত মারমাদের শুকর পালানের রীতি একই। সহজে পয়সা উর্পাজন করতে চায়। শুকরের জন্য আলাদা আবাসস্থল (রাখার ঘর/ছাউনি) বানাতে চায় না। ইদানিং আমাদের গ্রামে কিছু পরিবারকে দেখেছি মুরগীর জন্যও ঘর তৈরি করে না। রাতে মুরগীরা ঘুমায় গাছের ডালে। কিন্তু ছেলেবেলায় দেখেছি, শত গরীব হোক, নড়বড়ে হলেও তার ঘরের পিছনে একটি মুরগীর ঘর ঠিকই থাকতো। দিন দিন অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পশুপালনে সহজ, উন্নত হওয়ার বদলে আরো নিম্ন গতি লক্ষ্য করি।
তুলনামূলকভাবে বমদের পরে চাকমাদের পাড়াগুলোর সৌন্দর্য চোখে পড়ে। চাকমাদের কিছু থাকুক না-থাকুক পায়খানা ঘর থাকে। পাহাড়ে পরিবারটি গরীব থেকে গরীব হতে থাকলে, দুটো জিনিসকে আঁকড়ে ধরে তা হলো মদ বিক্রি আর শুকর পালন। এটি পাহাড়ে পাহাড়িদের অনেকের বেলায় বেঁচে থাকার জন্য আয়ের সর্বশেষ আশ্রয়। চাকমাদের মাঝে শুকর পালনে একটা শৃংখলা দেখা যায়। মারমাদের ক্ষেত্রে এ কথাটি সব পাড়ার বেলায় খাটে না। পশু লালন-পালন করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে। দিন বদল হলেও মারমাদের পশু পালন পদ্ধতিতে, বসবাস রীতিতে পরিবর্তন এসেছে খুব সামান্য। পাড়ার পরিবেশ পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে খুব কম লোকজন। আমার প্রশ্ন জাগে, চাকমাদের ঘরে ঘরে পায়খানা ব্যবহার অভ্যাস হলেও ত্রিপুরা, মারমাদের পাড়ায় এই অভ্যাসটি গড়ে উঠেনি কেন? কেন শিখতে পারিনি? এই স্বাস্থ্যাভ্যাসটি গড়ে তোলার জন্য কেন কাজ হয়নি? এখনও কেন হচ্ছে না?
কাগজে কলমে এই খাতে কাজ হয়েছে অনেক; কিন্তু দুটি খ্যাং পাড়া, দুটি ম্রো পাড়া, পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় দুই-চারটি পরিচ্ছন্ন মারমা পাড়া কি দেখাতে পারি? ময়মনসিংহ মুক্তগাছা জমিদার পরিবারের হেমেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরীর (১৮৮১-১৯৩৮) লেখা ‘খেদা’ তে সেই সময়ে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে হাতি ধরার বর্ণনায় দূর্গম এলাকায় তিপ্রা, হালাম, কুকিদের ঘরের নির্মাণকৌশলের প্রশংসা পাওয়া যায়। তিনি পাড়া বর্ণনায় এক জায়গায় বলেছেন “কতগুলি পালিত শুকর মেথরের কার্যটা সম্পন্ন করে” (দেখুন: কমল চৌধুরী (সংকলন), জঙ্গল জঙ্গলে, পৃষ্ঠা ২০৫, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ২০০৬) কথাটি আমাদের পাহাড়ের কিছু জনগোষ্ঠীর পাড়াগুলোর বেলায়ও এখনো প্রযোজ্য। আমরা অনেক পাড়া খুঁজে পাবো যে পাড়াগুলোতে পানি পায়খানার সুবিধাদি নিশ্চিত করতে পারিনি এবং সেই সব পাড়াগুলোতে পাড়ার শুকরগুলোই মেথরের ভূমিকা পালন করে।
খাগড়াছড়ি সদরকে ঘিরে নতুন নতুন কত পাড়া কত আকর্ষণীয় নামে গড়ে উঠেছে; কিন্তু মারমা পাড়াগুলোতে এখনো চা দোকান আর বট গাছের নীচে বসে আড্ডা নিয়েই চলছে। মহালছড়ির চোংড়াছড়ি মৌজা পাড়াতে অবশিষ্ট বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো রাস্তার ধারে দুই-চারটি চা দোকান। আমার নিজের চোংড়াছড়ি মুখ পাড়াটিও এখন এই রোগে আক্রান্ত। বাবার যতদিন শক্তি (বয়স) ছিল কোন চা দোকান বসতে দেননি। এখন ২০টি ঘরের জন্য ৪টি চা দোকান হয়েছে। কাস্টমার টানতে নানা প্রতিযোগিতা চলছে যেমন: টিভি বসিয়ে সস্তা মার্কা গান বাজনা ছেড়ে দেয়া, নিম্নমানের সিনেমা চালিয়ে রাখা। দাদুর সময়ে পাড়ায় উন্মুক্তভাবে ছেড়ে দিয়ে যত্রতত্র শুকর পালন হতে দেখিনি। ফলে সে সময়ে পাড়ায় নানা ফলমূল আর কলা বাগানেরও অভাব ছিল না। সারা বছর ফলমূল পাওয়া যেতো। পাড়ায় এখন নিষেধ করার আর কেউ নেই, শুকরগুলোকে যেখানে সেখানে বেঁধে রাখতে দেখা যায়। গত দুই দশকে দেখতে দেখতে গ্রাম থেকে নানা ফলমূলের গাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পাড়ায় থাকা কলা বাগানগুলো হারিয়ে গেছে প্রায় দশ বছর আগে। যে পাড়া থেকে প্রতি সপ্তাহে কলা বিক্রির ধুম পড়তো এখন সেই পাড়াবাসীকে বাজার থেকে কলা কিনে এনে খেতে হয়।
পাহাড়ে একটি জায়গায় বড় উন্নতি হয়েছে, মিলেমিশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। বিহারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। সকলে স্বর্গের সন্ধানে পয়সা খরচ করেই চলেছি।
পাহাড়ে জীবিত মাছ মাংস ক্রেতার সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ক্রেতা ধরে রাখতে এখন রেডিমেইড মুরগী আর কাটা শামুক বিক্রি হতে দেখা যায়। অনেক পাহাড়ি পরিবার পশুপালন আর করতে চায় না। আর যারা পালন করছে তাদের মাঝেও এক ধরনের অযত্ন-অবহেলার দেখা মেলে।
এখন গ্রামে গেলে শুকর হত্যার চিৎকার শোনা যায় কম। পাহাড়ে অনেকে পশু হত্যার নতুনত্ব আনতে গিয়ে আরো নৃশংস পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। পন্থাটি পশুবান্ধব না হয়ে ব্যবসায় লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে বের করা হয়েছে। এখন নাকি পাহাড়ের কোথাও কোথাও শুকর হত্যা করা হয় পানিতে ডুবিয়ে। শুকরকে নাকি বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এতে নাকি শুকরটি পানি খেয়ে ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কতটুকু সত্য জানি না, তবে এই প্রক্রিয়াতেই এখন অনেক ব্যবসায়ীরা শুকর হত্যা করছে বলে শোনা যায়। বাড়তি কিছু লাভের আশায় এই নব্য পন্থাটি কিছু কিছু জায়গায় প্রয়োগ হচ্ছে বলে লোকের মুখে শুনে থাকি।
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও হাতি বিশেষজ্ঞ ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী ভারতের কুকিদের ‘কুত্তাপোলাও’ রান্নার প্রণালী বর্ণনা করতে গিয়ে একটু বাড়িয়ে বলেছেন কিনা জানি না, তবে তাও প্রাণীবান্ধব বলা যায় না। তিনি লিখেছেন, “কুকিরা একটি জ্যান্ত কুকুরকে বেঁধে ঠেসে ঠেসে নুন, হলুদ, লঙ্কা মেখে চাল খাওয়ায়। খেতে না চাইলে একসময় লাঠি দিয়ে গুঁজে গুঁজে কুকুরের মুখে চাল ভরানো হয়। পরে কুকুরের মুখটি বেঁধে কুকুরটিকে আগুনে ঝলসিয়ে তৈরি করা হয় মজাদার কুত্তাপোলাও” (দেখুন: ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী, হাতির কথা, পৃষ্ঠা ১০৩, আনন্দ পাবলিশার্স, সপ্তম মুদ্রণ ২০১৮, কলকাতা)। পাহাড়ে অন্য সকল সময়ের তুলনায় সকলের মাঝে ধর্ম চর্চা বেড়েছে সত্যি, কিন্তু শুকর হত্যার নব্য পন্থাটি নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হয়েছে বলেই মনে করি।
লেখক: ঞ্যোহ্লা মং, উন্নয়নকর্মী