পাহাড়ে ক্ষনজন্মা আলোচিত এক তরুণের নাম নিং প্রু চাই মারমা। পড়ালেখা শেষ করে চাকরির সুবাদে নানা জায়গায় কাজ করলেও সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ তাকে আলোড়িত করে। একইভাবে তরুণদের মাঝে তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। ২০০৪-০৫ সালে আমরা যখন ১০০ টাকার শিক্ষা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলাম, সেই সময়ে শিক্ষা প্রকল্পের এক সদস্যের কাছ থেকে তাঁর নাম প্রস্তাব আসে। আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে মাসিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম বলে মনে আছে।
আরো বেশ পরে কয়েকবার তাঁর সাথে খাগড়াছড়িতে দেখা হয়, কথা হয়। তারপর র্দীঘ বিরতি দিয়ে ২০১৭ সালে ৮ ডিসেম্বর তারিখে তাঁর কাছ থেকে একটি খুদে বার্তা পাই। মূলতঃ তিনি আমাকে অনেকটা অভিযোগ করে লিখেছিলেন “যে ফাউন্ডেশনের নাম নিয়ে আপনি সমালোচনা করেছিলেন, সে ফাউন্ডেশনের নামে বর্তমানে অনেকে উচ্চশিক্ষার বৃত্তি পাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে ৫জন উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছে”। তিনি আরো লেখেন “ আপনি যে নামের জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’ করেছিলেন তা ঠিক হয়নি” ইত্যাদি।
তাঁর ক্ষুদে বার্তাটি পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিলাম। দুদিন পর আমি প্রতি উত্তর দিতে গিয়ে লিখেছিলাম ‘তুমি কি কোথাও ভুল করছো? আমি চ্যালেঞ্জ করতে যাবো কেন? ” একইসাথে শিক্ষা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট আমার পূর্বের কিছু প্রকাশিত লেখা তাকে পাঠিয়েছিলাম, পড়ে দেখার জন্য। একদিন পর তিনি নরম সুরে বেশ কিছু খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এভাবেই শুরু তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ। এখানে বলে রাখা ভাল, খাগড়াছড়িতে থাকাকালীন সময়ে একদল উচ্চশিক্ষিত মারমা তরুণ একজন শিক্ষকের নামে গঠিত শিক্ষা ফাউন্ডেশনে আমায় অংশ নিতে অনুরোধ করেছিলেন। ব্যক্তি নামে গঠিত ফাউন্ডেশনের নাম নিয়ে আমি আমার মতামত জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম ‘শিক্ষা ফাউন্ডেশন’ হতেই পারে কিন্তু যে শিক্ষকের নামে ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে তাঁর সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সমাজে তাঁর কোন অংশে অবদান আছে কিনা তাও জানি না। তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদেরকেও খুব বেশি পড়ালেখা করাতে পারেননি বলে জানি মাত্র।। তিনি নিজের ছেলেমেয়েকেও পড়ালেখা করাতে পারেননি বলে জানি মাত্র। তবে আমরা তরুণ মারমা শিক্ষিত সমাজ কেন তাকে স্মরণ করে শিক্ষা উন্নয়নে ফাউন্ডেশন গঠন করবো?’ তাই সে সময়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের আরো বলেছিলাম, ‘শিক্ষকের কর্ম নিয়ে আমায় এক পৃষ্ঠায় কেউ লিখে দেন আমি বুঝার চেষ্টা করি এবং অন্যদেরকেও যাতে বলতে পারি এবং অংশগ্রহণ করাতে পারি।’ এই ছিল মূলতঃ আমার বক্তব্য। কিন্তু আমায় কেউ তাঁর কর্মের বর্ণনা না দিলেও কয়েকজন গুণী মারমার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেও আশাব্যঞ্জক কিছু পাইনি বলে অংশগ্রহণ করিনি। তাই হয়তো নিংপ্রু চাই মারমা সহ কিছু তরুণ আমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন।
আবার ফিরে আসি নিংপ্রু সম্পর্কে। তারপরও এক সময় আমাদের খুব ভাল যোগাযোগ গড়ে উঠে। তিনি স্বপ্নের পাঠশালা প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে তাঁর নানা উদ্যোগ নিয়ে আমায় খুদে বার্তা পাঠাতেন। কিংবা কোন উদ্যোগ নিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট করে থাকলে আমায় দৃষ্টি আকষর্ণের জন্য লিংক পাঠাতেন।
আমার একটি বই প্রকাশিত হলে বইটি পড়ে একটি লম্বা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। আমায় একদিন জানিয়েছিলেন যে, তিনি সাহস করে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসককে ফেসবুকে একটি চিঠি (আবেদন) লিখেছেন। তাঁর স্বপ্নের পাঠশালা আর নিজের জীবনী লেখার পরামর্শ চেয়ে আমায় একটি খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। আমেরিকা প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. মংসানু দা নাকি উৎসাহিত করছিলেন জীবনী লিখতে। আমি আমার চিন্তাগুলো জানিয়ে একটা লম্বা সময় নিয়ে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম জীবনী মানে যেন শুধু নিজের গল্প না হয়। তোমার দেখা ছেলেবেলার সিঙ্গিনালাসহ আশপাশের নানান বিষয়-আশয়, পাড়া-পরিবারগুলোকেও যাতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বলেছিলাম, মহালছড়ি একটি পুরাতনতম থানা, মুক্তিযুদ্ধে মহালছড়িবাসীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে; কিন্তু নানাভাবে আমাদের মহালছড়ি অনালোচিত-ই রয়েছে। মহালছড়ি নিয়ে লেখার অনেক উপাদান আছে যা আমাদেরকেই লিপিবদ্ধ করা উচিত।
আমায় একদিন কথা প্রসঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর অরণ্যের অধিকার বইটি দাবি করেছিলেন। লকডাউনে বন্ধ থাকায় অনলাইনে অনেক খুঁজেও বইটি সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা, আনিসুজ্জামান স্যারের বিপুলা পৃথিবী, নিমাই এর জার্নালিস্টের জার্নাল আর ছোটদের উপযোগী লেখা আবুল মোমেনের গৌতম বুদ্ধসহ সবমিলে ৪-৫টি বই পাঠিয়েছিলাম।
তিনি আমার কাছে স্বপ্নের পাঠশালা এবং তাঁর চিকিৎসায় হৃদয়বান কোন একজন মানুষকে এগিয়ে আসার আহবান নিয়ে একটি লেখা প্রত্যাশা করেছিলেন, আমি আশ্বাসও দিয়েছিলাম। ভেবে রেখেছিলাম তাঁর পাঠশালায় একদিন সচক্ষে দেখে একটি লেখা প্রকাশ করবো, তা আর হয়নি। আমি তাঁর ক্ষুদ্র প্রত্যাশাটুকু পূরণ করতে পারিনি।
ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসবেন বলে আমায় জানিয়েছিলেন। ভেবে রেখেছিলাম দেখা করতে যাবো কিন্তু ফেসবুকে চিকিৎসা কেন্দ্রে ভিড় না করার আহবান দেখে আর যোগাযোগ হয়নি।
সম্প্রতি মহালছড়ি গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে তাকে কয়েকবার রিং দিয়েও না পেয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলাম। আমাদের আগের যোগাযোগে প্রায় বলতেন মোবাইল করে না পেলে, আমি যেন কিছু মনে না করি। শরীরের তীব্র ব্যাথা, যন্ত্রণা নিয়ে প্রায় ঘুমাতে পারতেন না বলে আমাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।
তাঁর কলের অপেক্ষায় ছিলাম। কিছু পরিকল্পনাও ছিল। ঢাকা ছাড়ার আগে আমার এক সহপাঠি ও বন্ধু, বর্তমানে উপসচিব সোনামনি চাকমা পাঠশালার জন্য বুক সেলফ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল এবং বলেছিল আমি যেন স্থানীয়ভাবে বানানোর খরচ জেনে আসি। সে ইতোমধ্যে দুই কিস্তিতে ১০০টির ও অধিক বই পাঠশালার জন্য কিনে পাঠিয়েছে বলে জানি।
নিংপ্রু মারমার স্বপ্নের পাঠশালা অনেক তরুণকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিছু তরুণ অনুপ্রাণিত হয়ে জেলার বিভিন্ন পাড়ায় পাঠশালা গড়ে তুলেছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জেনেছি।
তাঁর পাঠশালা শুধু বই পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধূলা, ছবি দেখা, নাচ-গান, শিক্ষা সফর, দুর্বল ছাত্রছাত্রীদের কোচিং এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষ তরুণ ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে পড়ানোর ন্যায় কার্যক্রমগুলো পাহাড় পেরিয়ে সমতলের অনেককে আকৃষ্ট করেছিল। তাই তাঁকে নিয়ে জাতীয় পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার হতে দেখেছি।
তাঁর অকাল মৃত্যুতে অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞানী ড. মংসানু মারমা লিখেছেন “… কিন্তু বিছানা থেকে উঠেই জানলাম পাহাড়ে এক স্বপ্নবাজ নিংপ্রু আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে অনন্তযাত্রায় শামিল হয়েছে। তাঁর মৃত্যু খুব কাছাকাছি, তা জেনে কয়েক সপ্তাহ আগে এক খুদে বার্তায় লিখেছিলাম মনে রেখো, তোমার সুকর্ম অনেক। তোমার জন্য অনেক ছেলেমেয়েরা এখনো স্বপ্ন দেখতে পায়।” মন্তব্য কলামে চিত্রশিল্পী জয়দেব রোয়াজা লিখেছেন “নিংপ্রু’র সাথে আমারও মেসেঞ্জারে টুকটাক আলাপ হতো, কথা দিয়েছিলাম করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লাইব্রেরিতে কয়েকদিনের আর্ট ওয়ার্কশপ করবো। সেই সময় দেখা হবে। আর দেখা হলো না। তবে আগামী বছর আমি অবশ্যই যাবো। তাঁর স্বপ্নকে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে আমাদের।”
এক সময় উপজেলা পর্যায়েও পাবলিক লাইব্রেরি চালু ছিল। দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে উপজেলা পর্যায়ে পাবলিক লাইব্রেরিগুলো বন্ধ হয়ে আছে (এই বিষয়ে আমি লিখেছিলামও দেখুন: ‘পাবলিক লাইব্রেরি কেন বন্ধ থাকবে’- ঞ্যোহ্লা মং, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬, সুপ্রভাত বাংলাদেশ)। আমরা কথায় কথায় তরুণরা মোবাইলে আসক্তি, ভিডিও গেমের আসক্তি, মাদকাশক্তি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি; কিন্তু তরুণদের অবসর সময়গুলোকে ভাল কাজে ব্যবহারের পন্থাগুলোকে বন্ধ রেখেই ভাল ভাল স্বপ্ন দেখছি মাত্র। আমরা ক’জন (জটিল বিন্দু চাকমা, পিপলু রাখাইন, পিযুষ চাকমা, সুইচিং মিন ও আমি) এক সময় মহালছড়িতে বন্ধ থাকা পাবলিক লাইব্রেরি খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। পাবলিক লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে সংবাদপত্র পাঠক ফোরাম গঠন করেছিলাম। তরুণরা বিকালবেলায় দল বেঁধে লাইব্রেরিতে পড়তে শুরু করেছিল। পাঠক ফোরামের সদস্যরা বিভিন্ন লেখালেখি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার জিততে শুরু করেছিল; কিন্তু মহালছড়িতে অনাকাক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেসব আবার বন্ধ হয়ে যায়। এইজন্য দরকার উদ্যোগের ধারাবাহিকতা আর একদল স্বপ্নবাজ তরুণ। নিংপ্রু’র মতো একজন স্বপ্নবাজ তরুণ দিয়ে সমাজ আলোকিত করা সম্ভব নয়।
পাহাড়ের সংবাদকর্মী প্রদীপ চৌধুরী লিখেছেন “আমরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আতশবাজি পোড়াই। কিন্তু একজন উচ্চশিক্ষিত নিংপ্রু মারমার স্বপ্নের পাঠশালার গুরুত্ব বুঝতে পারি না।” তাই আমাদের দরকার ঘরে ঘরে স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী।
বর্তমান সময়েও বই পড়া, পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা এতটুকু কমে যায়নি। নিংপ্রু মারমার স্বপ্নের পাঠশালা তার একটি প্রমাণ। নিংপ্রু’র পাঠশালা আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্বপ্নের পাঠশালা বাঁচলে নিংপ্রু বাঁচবে, আমাদের তরুণ সমাজও স্বপ্নের পথে ধাবিত হবে।
লেখক: ঞ্যোহ্লা মং, উন্নয়নকর্মী। ইমেইল: nmong7@yahoo.com