তানিয়া মেহনাজ ( ছদ্মনাম )। পেশায় একজন প্রকৌশলী এবং তিনি দুই সন্তানের মা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অফিসে যেতে না হলেও তাঁর অফিসিয়াল কাজকর্ম সময়মতই বাড়ি থেকে করতে হচ্ছে। কাজটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিলেন, আদতে দেখা গেল অফিসের কাজ বাড়ি থেকে করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে।
তিনি বলেন, ‘দুই সন্তানের স্কুল বন্ধ। ওদের বাড়িতে বসিয়ে নানারকম কাজে ব্যস্ত রাখতে হচ্ছে, এটা সেটা বানিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে। বাড়িঘর অগোছালো করছে। সেগুলো গুছিয়ে রাখতে হচ্ছে। ফলে আমার ডেডলাইন প্রতিদিন মিস হয়ে যাচ্ছে। এমনকি মনে হচ্ছে বাচ্চাদেরকেও আমি আগের মত কোয়ালিটি সময়টা দিতে পারছিনা।’
নাহিদ হাসান (ছদ্মনাম) গৃহিনী। তিনিও প্রায় একইরকম অভিজ্ঞতার কথা বললেন। করোনার জন্য বাড়ির সবার অফিস বন্ধ। স্বামী, দেবর, শ্বশুর ,শাশুড়ি সন্তান সবাই বাসায়। বাসার সাহায্যকারীকেও আসতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই বাড়ির প্রায় সব কাজের চাপ এসে পড়েছে আমার উপর। ‘এতোগুলো মানুষ সারাদিন বাসায় থাকলে কাজের বাড়তি চাপ থাকে। তার উপর বাড়ির ভেতরের এবং বাড়ির বাইরে থাকা পরিবারের সদ্যস্যদের চিন্তাও তো আছে’ নাহিদ বলেন।
তানিয়া কিংবা নাহিদের মত এমন হাজার হাজার নারী প্রতিদিন সংসার, কাজ এবং পরিবারের এই নতুন মাত্রার চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন করোনা পরিস্থিতিতে। গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের কাজের ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় পরিবর্তন এলেও প্রাথমিকভাবে এখনো নারীদের কাঁধেই সংসারের মূল চাপটা রয়ে গেছে। অ্যাকশন এইডের ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সাধারণ পরিবারে একজন নারী গড়ে ছয় ঘণ্টা বাড়ির নানা কাজে সময় দেয়, যেখানে সেসব কাজে পুরুষ সময় দেয় প্রায় এক ঘণ্টারও কম।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় নারীর ঘরের বাইরে এবং ভিতরে এমনিতেই নানা কাজের চাপ। সেই চাপ দ্বিগুণ করেছে করোনা পরিস্থিতি। সাধারণত নারীরাই প্রাথমিক ভাবে গৃহস্থালি কাজগুলো করে থাকেন। তার উপর আছে সন্তান পালন এবং অন্যদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব। বাড়ির অন্য লোকেরা সাহায্য করলেও দশদিক সামলে প্রত্যেকের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু নিশ্চিত করাটা কঠিন। কাজেই সাধারণত কে পরিবারের সকলের দায়িত্বে থাকেন, এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে লিঙ্গভিত্তিক দায়িত্ব জড়িত।
আমেরিকা ভিত্তিক নারী সংগঠন এলিভেট নেটওয়ার্ক এর সিইও কৃষ্টি ওয়ালস বে’র মতে, ‘নারীরাই পরিবারের প্রধান স্বাস্থ্যকর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা, খাদ্য কর্মকর্তা এবং সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা’। তিনি আরও বলেন, ‘নারীদের দায়িত্বের মাত্রা আরও বহুগুণ বেড়ে যায় যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে, যখন গতানুগতিক রুটিনের বাইরে সবকিছু চলে। সে চাপটা সত্যিই অনেক।’
তাসনিম ইসলামের বাবা দেশের বাইরে থাকেন। মা ও ছোট ভাই আর তাসনিমের সংসারের সব সিদ্ধান্ত এবং কাজ মূলত তাসনিম এবং তার মাকেই করতে হয়। ‘আমি অনলাইেন একটা ব্যবসা চালাই। এই লকডাউনের সময়টাতে আমার ক্লায়েন্টদের কাছে পণ্য পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেই সাথে বাজার, ব্যাংক, বিল, বাসার কাজ সব কিছু দেখতে হচ্ছে। বাবা আরেক দেশ থেকে আসতে পারছেন না। তিনি অসুস্থ। মাকে নিয়েও বেশ চিন্তিত আমরা।’
অনেক বিশেষজ্ঞ এই কঠিন সময়টাকে দুইভাবে বিশ্লেষণ করেন। ‘একদিকে কোভিড১৯ এর মানসিক চাপ। আমরা কি প্রস্তুত আমাদের যা দরকার সব নিয়ে, প্রিয়জনদের ব্যাপারে শঙ্কা , অন্যদিকে বিশেষ সময়ের আর্থিক টানাপোড়েন এর শঙ্কা।’
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীরা পুরুষের তুলনায় বাড়িতে সময় বেশিতো দিচ্ছেনই। এছাড়াও সন্তান পালন এমনকি পরিবারের বয়ষ্ক সদস্যদের দেখাশোনা করার দায়িত্বও সাধারণত নারীদের উপরই ন্যস্ত থাকে। আর পৃথিবীব্যাপী রোগবালাইয়ের সময়গুলোতে এই দায়িত্বও বহুগুণে বেড়ে যায়।
বিশ্বজোড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজধারায় নারী পুরুষের কাজের ক্ষেত্রে বৈষম্যের মাত্রা নানা প্রকারের। ঐতিহ্যগতভাবেই ঘরের কাজ নারী করবে আর পুরুষ করবে বাইরের কাজ-এই ধারনা থেকে বের হতে পারছেনা আধুনিক সমাজ। যদিও নারীরা সমান তালেই সকল পেশায় পুরুষের সাথে কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু ঘরের কাজের দায়িত্বটা এখনো সমবণ্টন তো হয়ইনি, বরং বেড়েছে। কারণ নারীকে ঘরে বাইরে দুই জায়গাতেই কাজ করে যেতে হচ্ছে আর এই কাজের মাত্রা অন্যান্য দুর্যোগ পরিস্থিতির সময়ের মত বহুগুণ বেড়ে গেছে করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে।
লেখক: মাহজাবীন ফেরদৌস। তথ্যসূত্রঃ দি গার্ডিয়ান ও একশনএইড।