মানুষ সামাজিক জীব।সমাজ আর সমাজের মানুষ আমাকে নিয়ে কী ভাবছে এই চিন্তাবোধ নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি। আর নারী হয়ে জন্ম নিলে সেই বোধ আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। আর তাই অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েও নিজের অসুবিধাগুলো বলতে পারে খুব কম সংখ্যক নারী। নিজের অধিকার আদায়ও করতে পারে না অধিকাংশ নারী। নিজের বাড়িতেই নিকট আত্মীয় দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েও প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ করতে পারে খুব কম সংখ্যক নারী বা শিশু।
তাই নিগ্রহের শিকার নারী বা শিশুকে প্রতিবাদ করার শিক্ষাটা দিতে হবে পরিবারকেই। কয়েকদিন ধরে পাবলিক বাসে গা ঘেঁষে দাড়ানো নিয়ে খুব আলোচনা চলছে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর পক্ষে বা বিপক্ষে প্রচুর কথা হচ্ছে। যারা এর বিপক্ষে বলছেন, তারা কি গা ঘেঁষে দাড়ানো বলতে কী বোঝায় তা আসলেই জানেন কিনা এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।
আমি তাদেরকে তেমন কিছু নমুনা জানাতে চাচ্ছি।
নমুনা ১: বাসের সিটের জানালার সাইডে বসেছে একটি মেয়ে। পাশের সিটে পুরুষ পুরুষটি একটু পরপর জানালা দিয়ে থুতু ফেলছে ও কাশি দিচ্ছে। বাইরে থেকে এমনই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভিতরের কাহিনী হল পুরুষটি জানালার কাছে মুখ নিতে গিয়ে বারবার মেয়েটির বুক স্পর্শ করার চেষ্টা করছে।
নমুনা ২: মেয়েটি বাসের ভিতরের দিকের সিটে বসেছে। পাশে একটি পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। এর মাঝে পুরুষটি তার নিজের বিশেষ অঙ্গটি বারবার মেয়েটির বাহুতে ঘষাঘষি করার চেষ্টা করছে।
নমুনা ৩: ভিড়ে পুরুষ ও নারী দু‘জনই দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষটি নারীটির শরীরের যে অংশ যতটুকু পারছে ততোটুকুই স্পর্শ করছে।
নমুনা ৪: নারী সামনের সিটে বসে আছে। পুরুষটি পিছনের সিটে বসে সিটের ফাঁকে পা বা হাত দিয়ে খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বাসে নিয়মিত যাতায়াত করেন যেসব নারী তারা কোনদিনও এসব অভিজ্ঞতার শিকার হননি, এমন কেউ আসলেই কি আছেন? আর এগুলো মেনে নিয়েই বাসে চলতে হবে, এ মানসিকতা তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগেনা আমাদের নারীদের । কেননা তাদের গাড়ি নেই। বাস তাদের বাবার না। দুঃখের বিষয় হল অধিকাংশ নারী বাসে নিগ্রহের প্রতিবাদ করতে পারে না লজ্জায় বা সংকোচে। আর যারা প্রতিবাদ করে, তারা তাৎক্ষণিক সমর্থন পান খুবই কম। সেক্ষেত্রে তাদেরকে শুনতে হয়, এতো অসুবিধা হলে বাসে না চড়ে প্রাইভেটে চলেন, পাবলিক বাসে উঠলে এমন হবেই ইত্যাদি নানাবিধ কথা।
তবু প্রতিবাদটা হওয়া উচিত জোরালো। কেউ সমর্থন না করুক, নিজের সমস্যা নিজেকেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দ্বারা সমাধান করতে হবে আর এ শিক্ষাটা পরিবারকেই দিতে হবে।
এবার একটু ফ্যাশন বিষয়ে কথা বলতে চাই। বাংলা কবিতা, সিনেমার ডায়ালগ, গানসহ বিভিন্ন ধরনের ডায়ালগ দিয়ে টিশার্ট তৈরির সংস্কৃতি বেশকিছুদিন ধরেই আমাদের দেশে চলছে। যেমনঃ “নাম বললে চাকরি থাকবে না”,” কি হিংসা হয়?” আমার মতো হতে চাও”,”মাইর হপে” এরকম নানাবিধ সংলাপ আমরা দেখত পাই। এগুলো বেশ জনপ্রিয় এবং এগুলো নিয়ে কোন সমালোচনাও হয়নি।
যারা বাজারজাত করেছে তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও কাউকে তেমন ভাবতে দেখিনি। অথচ “গা ঘেঁষে দাড়াবেন না” এই সংলাপটিকে ঘিরে তোলপাড় চলছে। খাটের তলা থেকে যেন কেউ চিৎকার করে বলছে, আমি কলা খাইনি। আসুন আমরা নিজেদেরকে বদলাই। নিজে নিগ্রহের শিকার হলে, তা চিৎকার করে বলতে শিখি। আর কেউ প্রতিবাদ করলে, বিষয়টি অনুধাবন করে তাকে সমর্থন দেই। আর যারা নিগ্রহ করেন, তাদের বলতে চাই, মানুষ হন, শুধু পুরুষ হয়ে বাঁচবেন না প্লিজ।
- জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণী, শিশুতোষ লেখক