আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের একটি সংবাদে ঢাকাকে নিয়ে কী শব্দ ব্যবহার করেছে, এ মাথাব্যথা আমার নাই কারণ আমার মাথা শূন্য কলস না যে, যে কেউ একটি টোকা দিলেই ঝনঝন করে বেজে উঠবে। কখনো কখনো মার খেয়ে বিচার চাইতে গেলে মারের চেয়েও বড় বঞ্চনা ও গ্লানি তৈরি হয়। সুতরাং কখন প্রতিবাদ করবেন আর কখন করবেন না, এই বোধটা প্রতিবাদের চেয়ে বেশি জরুরি।
ধরুন, আপনাকে কেউ একজন চুদির ভাই বলে গালি দিয়েছে। আপনি সেটা শুনেছেনও। এখন চারপাশের সবাই বলাবলি করছে কাজটা কি ঠিক করেছে কিনা। পরে লোকটা এক বিয়ে বাড়িতে আপনাকে পেয়ে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে গিয়ে বলে বসলো “ভাই মনে কিছু নিয়েন না, সেদিন রাগের মাথায় আপনাকে ‘চুদির ভাই’ বলে গালটা দিয়ে ফেলেছি!”
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আনন্দবাজার পত্রিকার এমন সংবাদের সরাসরি প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ এটি প্রতিবাদের কোনো ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেল নয়। যদিও নেটিজেনরা ওই দুর্বল সংবাদের ‘খয়রাতি’ শব্দচয়নে দু’দেশের বন্ধুত্বকেই এখন কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলার সুযোগ পেয়েছেন। অনেকেই গাল ফুলিয়ে বসে আছেন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন প্রতিবাদ জানাচ্ছেনা এই ভেবে!
মনে রাখা দরকার, কখনো কখনো নীরব অবস্থানে থাকাও সিগনিফিক্যান্ট ডিপ্লোম্যাটিক রোল হয়ে উঠতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মরিয়া হয়ে সাপোর্ট সিক করছিলো, সে সময়ের খবরাখবরের দিকে যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন কোনো কোনো দেশ নীরব অবস্থানে থেকে আমাদের সহায়তা করতে চেয়েছিলো। তাছাড়া এনআরসি ইস্যুতেও বাংলাদেশের উদ্বেগ বিষয়ে ভারতের আনুষ্ঠানিক জবাব ছিলো এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এ নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তার কিছু নাই। তবে সাধারণ মানুষের চিন্তারতো আর শেষ নেই! আর এখানেই বুদ্ধিজীবীদের রোল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বুদ্ধিজীবীদের কাজ হচ্ছে সম্প্রদায় ও স্বসমাজের জনমত, রাজনীতি ও মূল্যবোধকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রভাবিত করা। এঁদের এই প্রভাবশক্তির জন্য আন্তোনিও গ্রামশি সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্বকে অপরিহার্য বলে মনে করতেন। তবে এ সম্প্রদায়ের সকলেই যে ব্যক্তিগতভাবে এরূপ প্রভাব খাটাতে সক্ষম তা নয়।
ইতিহাস বলছে, বাংলায় intelligentsia-র সন্ধান পাওয়া যায় উনিশ শতকের প্রথমভাগে। সে সময় রাজা রামমোহন রায় এবং ইয়ং বেঙ্গল নামে একটি প্রগতিবাদী গোষ্ঠী এমন কিছু প্রশ্ন তোলে যা সমকালীন বাংলার সমাজকে বিস্মিত করে। তবে বাংলায় এই বুদ্ধিবাদী আন্দোলনের শুরুটা হয় আরো অতীতে প্রাচীন ও মধ্যযুগে।
বুদ্ধিজীবী হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগের বাংলা ছিল প্রধানত যাজক-প্রভাবিত একটি রাষ্ট্র। তখন বুদ্ধিজীবী বলতে এই যাজকদেরই বোঝানো হতো এবং তাঁরাই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁদের সামাজিক মর্যাদাই একটি বৃহত্তর সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় ও কৌশল আবিষ্কারে প্রেরণা জোগাত।
তবে সময় বদলেছে, আধুনিক এ কালে সমাজ শুধুই মসজিদ মন্দির প্রভাবিত নয় এখানে বড় একটি ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম। সে কারণেই বলছি আনন্দবাজার পত্রিকাটার জন্মের ইতিহাস জেনে দেখতে পারেন চাইলে। জনরার জেনেটিকস অনুযায়ীই এই পত্রিকাটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রমোট করবে, প্যাট্রোন করবে। ভারত যখন এমনই এক সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে তখন তাদের জাতীয়তাবাদকে চাঙ্গা রাখা খুব জরুরি। এই প্রয়োজনটা নিশ্চয়ই আমরা বুঝতে পারছি। আর প্রয়োজন পুরণেই প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব মত পথ এস্টাবলিশ করতে দেশে-বিদেশে সব সময়ই কিছু বুদ্ধিজীবী প্রতিপালন করে। তারাই দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে এ কাজটা করে থাকে।
এবার প্রসঙ্গে আসি… শুনেছি, আনন্দবাজারের ওই সংবাদের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদককে ফোন করে বিষয়টা অবহিত করেছেন। আনন্দবাজারও তাদের পত্রিকায় আজ দুঃখ প্রকাশ করে সংশোধনী দিয়েছে। ভ্রম সংশোধন শিরোনামে আনন্দবাজার লিখেছে, ‘‘‘লাদাখের পরে ঢাকাকে পাশে টানছে বেজিং’-শীর্ষক খবরে খয়রাতি শব্দের ব্যবহারে অনেক পাঠক আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী।’’
এই গোটা বিষয়টাই ঘটেছে নন ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলে এবং অবশ্যই অনানুষ্ঠানিকভাবে। সরকার এখানে সরাসরি নাক গলায়নি তবে আমি মনে করি, এ জাতীয় বাদানুবাদের মাধ্যমে একটি মহলের দূরভিসন্ধিকে বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেয়া হয় আর এই বাদানুবাদের সুযোগ নিয়ে আনন্দবাজারও ভ্রম সংশোধনের নামে আরেকদফা বিষয়টাকে চটকায়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিলো। জিইয়ে রাখলো ইস্যুটাকে! উল্লেখ্য যে, পাত্রী দেখানোর কালে শ্যাম বর্ণের কনের আশেপাশে একাধিক গাঢ় বর্ণের পাত্রীকে রাখলে কনেকে ততোধিক গৌর দেখায়। সুতরাং যেকোনো বিষয়ে দু’দেশের বৈপরিত্য বাড়াতে পারলে কার লাভ হয় সেটার হিসাব পরিষ্কার থাকতে হয় বুদ্ধিজীবীদের।
দুঃখিত! এই লেখার মধ্য দিয়ে আমিও প্রকারান্তরে আরেকবার ওই পিন্ডি চটকালাম।