আজ থেকে আগামী ছয় মাস কিংবা এক বছর অথবা দশ বছর পর পৃথিবীটা কেমন হবে? কেমন থাকবে পৃথিবীর মানুষগুলো? বিশ্বজুড়ে আকস্মিক করোনা মহামারির আগমনের পর মানুষের সব পরিকল্পনা, জীবনযাত্রা, ধ্যানধারণাতে ভর করেছে অনিশ্চয়তা।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিটা রাষ্ট্র এবং তার জনগণ। তার উপর আছে করোনা পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতির ভয়াবহতার আশংকা। করোনা পরবর্তী পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কি হতে যাচ্ছে-তা নির্ভর করছে অনেককিছুর উপর। করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা তার মধ্যে সবচেয়ে উপরে।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণের প্রচলিত পদ্ধতিতে বাধ সাধা হয়েছে- অর্থাৎ লকডাউন। মানুষ এখন সব কিছু ফেলে গৃহে সময় কাটাচ্ছে। অফিস করছে বাড়ি থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এসবকিছুর প্রভাব অর্থনীতিতে বেশ ভয়াবহ। লকডাউনে ব্যবসা বন্ধ মানে উৎপাদন বন্ধ। উৎপাদন বন্ধ মানে আয় এবং মুনাফা বন্ধ। মুনাফা নেই তো কর্মী নিয়োগ বন্ধ এবং ছাঁটাই শুরু। তার ফল হল বেকারত্ব।
এই সমস্যার সাধারণ সমাধান হল সরকার তার জনগণের ভার বহন করবে সবকিছু ঠিক হওয়া পর্যন্ত। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো তাদের জনগণের দোরগোড়ায় সহায়তাসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে অর্থের জোগানও দিচ্ছে। কিন্তু এর বাইরে যে সকল রাষ্ট্রের পক্ষে তা করা সম্ভব না তাদের উপর আছে বাড়তি চাপ। এরকম অনেক দেশ আছে যেখানে উন্নত রাষ্ট্রের মত লকডাউন খাটেনা। তাছাড়া লকডাউন উঠে গেলেই সবকিছু রাতারাতি আগের মত হয়ে যাবেনা। কাজেই এই বেকারত্ব এবং মুনাফা ঘাটতি সহসাই যাবার নয়।
অর্থনীতিবিদ জেমস মিডওয়ে লিখেছেন, কোভিড-১৯ এর সমস্যা সমাধানে এবং পরবর্তীতে যে কোনো মহামারিতে অর্থনৈতিক মন্দা এড়াতে দরকার উৎপাদনমুখী অর্থনীতি থেকে সরে আসা।
অর্থনীতি শুধু পণ্য ক্রয় এবং বিপণনে সীমাবদ্ধ না। অর্থনীতির মূল বিষয় হল, সম্পদকে মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারা। এই বেঁচে থাকার ধারণাতে পরিবর্তন আনার এখন সময় ঘনিয়ে এসেছে।
জাতিসঙ্ঘের চরম দারিদ্র্য এবং মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ফিলিপ আলস্টন বলেছেন, ‘অনেক রাষ্ট্র সোশাল ডারউইনিসম এর মতবাদ অনুযায়ী সমাজের নিম্ন আয়ের বা কম ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণিকে উপেক্ষা করে ধনীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর ফলে পৃথিবীজুড়ে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন অতিরিক্ত মানুষ দরিদ্রতার সম্মুখীন হবে’। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, আগামী কিছু মাস জুড়ে প্রায় দু’শো বিলিয়ন এর মত কাজ বিলীন হয়ে যাবে যার ফলে তিন দশমিক চার ট্রিলিওন ডলারের মত আয় কমে যাবে।
এর প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেই সকল নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা পরিবারে অনেকে একসাথে কষ্ট করে বাস করে, এবং না খেয়ে থাকার ভয়ে কিংবা চাকরি হারানোর ভয়ে মহামারির মধ্যেও কাজে যেতে বাধ্য হবে কিংবা কাজ হারাবে।
আবার এদের মাঝে আরেক শ্রেণীর বিপদ আরও বেশি যারা মধ্যম আয়ের কিন্তু মহামারির কালে কাজ হারাচ্ছে। কিন্তু সরকারের কিংবা বেসরকারি উদ্যোগেও যাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাচ্ছেনা কেননা, সাধারণ সময়ে তারা দরিদ্রের তালিকায় পড়েনা।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অতীতের অবাস্তব, স্বল্পমেয়াদী উন্নয়ন বা দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা কার্যক্রম থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে নজর বাড়ানো আবশ্যক যা সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করবে যেকোনো অজানা দুর্যোগ থেকে।
বাস্তুসংস্থানসংক্রান্ত অর্থনীতির গবেষক সাইমন মেয়ারের মতে, অর্থনীতির আলোকে দেখলে বিশ্ব অর্থনীতির চার রকম ভবিষ্যৎ পরিলক্ষিত হয়।
এর মধ্যে প্রথমটি হল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। যেখানে রাষ্ট্রের সবকিছু কেন্দ্রীভূত এবং বিনিময় মানের উপর নির্ভরশীল। এরকমটাই এখন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল যুক্তরাজ্য, স্পেন এবং ডেনমার্ক। এক্ষেত্রে বিনিময় মান দিয়ে অর্থনীতিকে মূল্যায়ন করা হয় এবং এখানে মনে করা হয়, যেকোনো বিপর্যয়ে রাষ্ট্র বাজারের দায়িত্ব নিবে। শ্রমিকের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন করবে যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয়। এমনকি ব্যাবসায়ে ঋণপ্রদান এবং সরাসরি অর্থ প্রদানও করে থাকে। কিন্তু এর স্থায়িত্বকাল হয় স্বল্প। কিন্তু করোনাকালে এই পন্থা অবলম্বন ফলপ্রসূ হবে যদি এই পরিস্থিতির মেয়াদকাল দীর্ঘ না হয়। কারণ এই পন্থায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে লকডাউন শিথিল রাখতে হবে। যা পরবর্তীতে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর হার বাড়িয়ে তুলবে যার প্রভাব পরবর্তীতে অর্থনীতিতে নেতিবাচকই হবে।
আরেকটি দিক হল দায়িত্বহীনতা ও বর্বরতা। আমরা যদি শুধুমাত্র মুদ্রামানকে উন্নয়নের সূচক ধরে এগোতে থাকি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার হাত না বাড়াই তো পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। এরকম পরিস্থিতি উদ্ভূত হতে পারে এরকম মহামারি কালে সরকারের যেকোনো ভুল পদক্ষেপে।
আরেক উপায় হল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে দেখা যায় যে, সেবাখাত কিংবা শ্রমিকের পাওনা পরিশোধের বিষয়গুলো জাতীয়করণ করা হয়। এটি শুধুমাত্র বাজার রক্ষার্থে করা তা নয় বরং জনগণের জীবনমান রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর উপায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অর্থনীতির সেই দিকে নজর দেয় যা শুধুমাত্র বাজার রক্ষা করবে তা নয় বরং সবার জন্য খাদ্য, বাসস্থান, সেবা ও ভোগ্যপণ্য, চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়। এক্ষেত্রে জনগণ আর সরকারের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়। জীবন রক্ষার জন্য যার যা কিছু যতটুকু প্রয়োজন তা সমভাবে বণ্টন হয়। মহামারির সময়কাল দীর্ঘ হলে এই ব্যবস্থার দিকে রাষ্ট্রকে নজর দিতে হতে পারে।
আরেকটি কার্যকর উপায় হিসেবে মেয়ার উল্লেখ করেন পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অর্থনীতির পথনির্দেশনামূলক নীতি হিসেবে এটি কাজে লাগতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বদলে ছোট দল কিংবা ব্যক্তি দ্বারা সম্প্রদায়ভিত্তিক সাহায্য ও সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ছোট দল কিংবা ব্যক্তির পক্ষে বড় পরিসরে এবং দ্রুততার সাথে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কিন্তু এলাকা বা সম্প্রদায়ভিত্তিক সহযোগিতা তাৎক্ষনিকভাবে এবং কার্যকর উপায়ে মহামারি ছড়িয়ে পড়া মোকাবিলা করতে সক্ষম। আমরা অতীতে পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা সংকটে এমন উপায় অবলম্বনে সফলতা দেখেছি। কিন্তু এটাকে রাষ্ট্রের অকৃতকার্যতা হিসেবে দেখা যেতে পারে আবার মানবিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
উপরিল্লিখিত প্রত্যেক পদ্ধতিগুলোরই সুবিধা অসুবিধা দুইদিকই রয়েছে। কোভিড১৯ আমাদেরকে আমাদের বেঁচে থাকার সংজ্ঞা কিংবা ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সাইমন মেয়ার মনে করেন, এর প্রতিউত্তরে আমাদের জীবন ও চিন্তাধারাতে আনতে হবে ব্যপক পরিবর্তন। অর্থনীতিকে শুধুমাত্র মুনাফা অর্জনের মাধ্যম এবং বাজারমুখিতা থেকে ফিরিয়ে মানুষের কল্যাণমুখী করতে হবে। সামাজিক পরিবর্তন যেকোনো সময় যেকোনো মাধ্যম থেকে আসতে পারে। আমাদের লক্ষ্য করতে হবে এই পরিবর্তন যেন মানুষের মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রেখে কল্যাণের প্রয়াসে হয়। এই মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক করনীয় কাজও হওয়া উচিত যার যার জায়গায় থেকে সেই মূল্যবোধকে পুঞ্জিভূত করা।