করোনাভাইরাস কি বিশ্বনেতৃত্বে আমেরিকার অবস্থান বদলে দেবে?

মোঃ রোবায়েত খন্দকার

প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার কোনোকিছুই আমেরিকার জনগণকে খুব বেশি স্পর্শ করতে পারেনি। যদিও তাদের রাজনীতিক এবং নীতিনির্ধারকরা দুটো যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিল। আমেরিকান জনগণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের কিছুটা টের পেয়েছিলো পার্ল হার্বারে আক্রমণের পরে। কিন্তু সেটাও মূল ভূখণ্ডের জনগনের উপর ইউরোপের মত প্রভাব ফেলেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বৈশ্বিক ক্ষমতার ম্যান্টল ব্রিটেন তার কাজিন আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় কোনো রকমের যুদ্ধ ছাড়াই; আর ঐদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বৈশ্বিক গুরু হিসেবে সামনে চলে আসে। অর্থাৎ দুই-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের যাত্রা শুরু।

হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুলের খ্যাতনামা প্রফেসর Graham T. Allison তার “Destined for War: Can America and China Escape Thucydides’s Trap?” বইতে গত পাঁচশ’ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন এই সময়টিতে বিশ্বক্ষমতায় নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে ১৬ বার। এই বৈশ্বিক ক্ষমতা পরিবর্তনের সময়ে ১২ বার যুদ্ধ হয়েছে এবং ৪ বার কোনোরকম যুদ্ধ ছাড়াই ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটেন থেকে আমেরিকার হাতে বিশ্ব নেতৃত্বের মশাল হস্তান্তর ওই ৪ বারের মধ্যে একটি। ১৭৭৬ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালের গৃহযুদ্ধ ছাড়া আমেরিকার জনগণকে তাদের মাটিতে যুদ্ধ করতে হয়নি। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে যেমন কোরিয়ান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ- প্রত্যেকটিতেই আমেরিকা অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু এই যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব আমেরিকার জনগণের উপর ততটা পড়েনি। এ সব যুদ্ধগুলোর মধ্যে আমেরিকা কিছু যুদ্ধে সরাসরি সৈন্য পাঠিয়েছে আবার কিছু যুদ্ধ প্রক্সি গ্রুপগুলোর মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেছে।

১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়ালের পতনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আরেকবার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়।সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে দুই মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব এক মেরুতে পরিণত হয়। এবং আমেরিকা তখন আবির্ভুত হয় একক ক্ষমতাশালী হিসেবে। আরেকজন খ্যাতনামা প্রফেসর Francis Fukuyama ওই সময়টিতে সোভিয়েত কম্যুনিজমের পতন এবং পশ্চিমা উদারবাদের আরোহন নিয়ে একটি বই লিখেন, নাম  “The End of History and the Last Man”। যদিও Fukuyama সাহেব সম্প্রতি স্বীকার করেছেন তার হাইপোথিসিসটি ভুল ছিল, এবং এটা এখনকার সময়ে প্রযোজ্য নয়।

স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাকে Charles Krauthammer তার ফরেন অ্যাফেয়ার্স আর্টিকেলে বর্ণনা করেছেন “The Unipolar Moment” হিসেবে। নব্বই থেকে দুই হাজার এই সময়টি প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের নেতৃত্বে আমেরিকা মোটামুটি ভালো সময় কাটায়। প্রেসিডেন্ট বুশের আমলে ২০০১ সালে আমেরিকা তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বহিঃ-আক্রমণের শিকার হয়। টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগনে সরাসরি আক্রমণ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির গতি প্রকৃতি বদলে দেয়।

পার্ল হার্বারে আক্রমণের পরে এই প্রথম আমেরিকানরা “Pre-emptive Strike” নীতি অনুসরন করা শুরু করে। এর মানে হল শত্রু পক্ষ আমেরিকার মাটি বা এর কোনো ইন্টারেস্টে আক্রমণ করার আগেই তাদের উপর আক্রমণ করা। যেমন ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের উপর আক্রমণ কিংবা ইরানের কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা এই পলিসির-ই অংশবিশেষ। পরবর্তীতে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন- প্রতিটি যুদ্ধেই আমেরিকা সরাসরি কিংবা যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করে। কিন্তু এতেও আমেরিকার জনগণ খুব বেশি বিচলিত হয়নি। আমেরিকানদের ক্ষেত্রে বলা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত তারা গাড়ি চালানোর জন্য কম দামে তেল পাচ্ছে ততক্ষন তারা বাইরের পৃথিবী নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না। কিন্তু করোনা নামক একটি ভাইরাসের আক্রমণ আমেরিকান মনন সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দিয়েছে।

শুরুর দিকে The Jacksonian President নামে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প হাসি-ঠাট্টা করে এর ভয়াবহতা উড়িয়ে দেন। বিভিন্ন প্রেস কনফারেন্স এবং বক্তৃতায় ট্রাম্প করোনাকে “Chinese Virus” বলে চীনকে দায়ী করা শুরু করেন। এমনকি আমেরিকার নামকরা কয়েকজন প্রফেসর চায়নাতে করোনা আক্রমণকে “The End of Chinese Era” বলতে শুরু করেন।বলা হয় চায়না আমেরিকার সাথে প্রতিযোগিতার আগেই হেরে গিয়েছে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে পৃথিবীর চিত্র বদলে গিয়েছে। চায়না এখন পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছে কিভাবে এই মহামারী সামাল দিতে হয়।

সন্দেহ নেই পূর্ব-এশিয়ার জনগণ এখন অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছেন আমেরিকার জনগণের থেকে। এখন অনেকে বলা শুরু করেছেন চায়নাকে হয়তো Graham T. Allison-এর “Thucydides’s Trap”-এ পড়তে নাও হতে পারে যদি আমেরিকা এই ক্রাইসিস থেকে উত্তরণে খুব বেশি সময় নেয়। ইসরায়েলি হিস্টোরিয়ান Yuval Noah Harari তার সম্প্রতি ফাইনান্সিয়াল টাইমস এর আর্টিকেল “the world after coronavirus” – এ লিখেছেন “China can teach the US many valuable lessons about coronavirus and how to deal with it.” আমেরিকার জনগণ  ১৯৩০ এর “Great Depression” বা মহামন্দার পরে এই প্রথমবারের মত এত ভয়াবহ রকমের অর্থনৈতিক মহামন্দার মুখোমুখি। যেই দেশের জনগণ বাইরের পৃথিবীর দুর্দশা দেখে অভ্যস্ত তারা এখন নিজেরাই বিচলিত।

খবরে দেখলাম আমেরিকাতে গত কয়েকদিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। অর্থাৎ তারা এখন মহা-দুর্যোগের কথা চিন্তা করে প্রাচীন কৌশলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমেরিকানরা সাধারণত জাতি হিসেবে সঞ্চয়ে বিশ্বাসী না। তারা অধিকাংশ জিনিসই ব্যাংক ঋণের টাকায় কেনে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করে। তাদের একটা বিশাল সংখ্যকের ইতোমধ্যেই চাকরি চলে গিয়েছে। এটা আমেরিকার জন্য বড় চিন্তার বিষয়। পৃথিবীর সব সফিস্টিকেটেড অস্ত্র, নামি-দামী বিজ্ঞানী এবং ল্যাব থাকার পরেও আমেরিকাসহ অধিকাংশ পৃথিবী আজ  অসহায়।
———————————-
লেখক: মোঃ রোবায়েত খন্দকার, সহকারি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), ৬ এপ্রিল ২০২০।

শেয়ার করুন