আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ উচিৎ নাকি অনুচিত?

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা কত দাঁড়ালো, মৃত্যু হয়েছে কতজনের, বা কয়জন সেরে উঠেছেন সে সম্পর্কে তথ্য প্রতিদিনই প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে এখনো পর্যন্ত তাঁদের কারোরই পরিচয় সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ৮ই মার্চ যেদিন করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ সম্পর্কে ঘোষণা এলো সেদিনও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিক সংক্রমিত ব্যক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন।

বাংলাদেশে রোগ ও রোগী শনাক্ত করার বিষয়টি তদারকি করছে সরকারি সংস্থা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বা আইইডিসিআর। তারা শুরু থেকেই বলে আসছে, সামাজিকভাবে কেউ যাতে হেয় প্রতিপন্ন না হয় সেজন্যই তারা আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করছে না। তবে অনেকেই মনে করছেন পরিচয় জানা থাকলে অন্যদের সতর্ক হতে সুবিধা হয়।

আক্রান্তের পরিচয় প্রকাশ করা উচিৎ কিনা সে নিয়ে বিবিসি বাংলার ফেসবুক পাতায় মতামত চাওয়া হয়েছিল। অনেকেই নানা ধরনের মত দিয়েছেন। যেমন তৌকির আহমেদ তার মতামত জানিয়ে লিখেছেন, “তথ্য গোপন করলেই গুজব তৈরি হয়। এখন এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা আর মানুষও এখন সেটা বুঝেছে। এখন আর সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করবে না। বরং ঐ রোগীর সংস্পর্শে কেউ এসে থাকলে নিজ থেকে কর্তৃপক্ষ কে জানাতে পারবে।” সাজ্জাদ আলম লিখেছেন, “বাংলার জনগণ অতি উৎসাহী। এরা দেখা যাবে ঠিকানা পাইলে বাড়ি ঘর জ্বালাবে, নয়তো আত্মীয়-স্বজনকে মারবে, কাজের কাজ কিছুই করবে না সুতরাং ঠিকানা প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন নাই।” মি. আলমের মতো অনেকেই মনে করেন পরিচয় প্রকাশ করলে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের অন্য সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক আঘাত করবে আশপাশের মানুষজন। আবার অনেকে লিখেছেন তথ্য জানা থাকলে বাকিদের পক্ষে ওই এলাকা এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে। সঠিক তথ্য পাওয়া মানুষের অধিকার এমন বক্তব্যও এসেছে বিবিসি বাংলার ফেসবুক পাতায়।

এ সম্পর্কে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, রোগীর পরিচয় প্রকাশ করা চিকিৎসা বিজ্ঞানের নৈতিকতা-বিরোধী। তিনি আরও বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোন দেশই রোগীর পরিচয় প্রকাশ করছে না। তারা পরিচয় প্রকাশ করছেন না কেন সে সম্পর্কে আরও ব্যাখ্যা দিয়ে মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, “এখানে রোগীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি চলে আসে। বাংলাদেশে মানুষজন অনেক সময় সংবেদনশীল আচরণ করে না। এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তদের তার সম্পর্ক তথ্য বের হল তারা স্টিগমাটাইজড হতে পারে। এই জন্য আমরা কারো সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছি না।”

আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা উচিৎ কিনা সে সম্পর্কে ব্র্যাকের সংক্রামক রোগ বিষয়ক প্রকল্পের প্রধান ড.শায়লা ইসলাম বলছেন, সাধারণত কোন সংক্রমণ রোগের ক্ষেত্রে রোগীর পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। তবে করোনাভাইরাসে কোন বাড়ির কেউ আক্রান্ত হলে সে সম্পর্কে তথ্য প্রতিবেশীকে জানানো উচিৎ যাতে তারা সচেতন হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির নাম পরিচয়ের থেকেও গুরুত্বপূর্ন বিষয় হল তিনি কোথায় গিয়েছিলেন এবং তার সংক্রমণের উৎস কোথায় সেটি খুঁজে বের করে সবাইকে জানানো। সেটি কিভাবে হতে পারে তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছেন, “যেমন ধরুন কোন দোকান, হাসপাতাল অথবা কোন ব্যাংকের কোন শাখায় হয়ত তিনি সংক্রমিত হয়েছেন। সেক্ষেত্রে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে সে কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কার সাথে মেলামেশা করেছে এগুলো খুঁজে আক্রান্ত ব্যক্তির সংক্রমণের উৎস বের করা দরকার। সংক্রমণের উৎস জানা থাকলে মানুষ সতর্ক হতে পারে এবং সেই যায়গাটি এড়িয়ে চলতে পারে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যেমন তাকে যখন স্বাস্থ্যকর্মীরা ইন্টার্ভিউ নেবে তখন যেন সে সকল তথ্য সঠিকভাবে দেয়। কিছু না লুকায়। সংক্রমণের উৎস পাওয়া গেলে সেটি তখন পাবলিকলি জানানো যায়।” তার তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকিতে থাকা অন্যদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হবে, আরও আক্রান্ত ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে।

সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে বেশ কয়েকটি খবর এসেছে করোনাভাইরাস আতংকে লোকজনের নাজেহাল হওয়ার। এই বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে মানবিক আচরণ করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানায়। ঐ বিবৃতিতে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছিল। যেমন, করোনাভাইরাস রয়েছে এমন সন্দেহে বাড়ি ঘেরাও ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় ভৈরবদী গ্রামে বেড়াতে আসা এক ইতালি ফেরত যুবকের শরীরে করোনাভাইরাস রয়েছে সন্দেহে বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছিল এলাকাবাসী। নেত্রকোনায় এক কিশোরীর জ্বর ওঠার পর তার বাড়িও ঘিরে রেখেছিল এলাকাবাসী। বগুড়ায় একজন শ্রমিককে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সহযাত্রীরা। এসব কারণে আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তির পালিয়ে যাওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

শেয়ার করুন