মুসলমানদের কাছে আল্লাহর ঘর মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ঘরকে তারা নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।
এ কারণে তারা নিজেদের বসবাসের জন্য যে ঘরটি নির্মাণ করে তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে মসজিদ ঘর তৈরি করে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জামায়াতে নামাজ আদায় করার জন্য বিশেষ তাগিদ দেয়ার কারণে মুমিন মুসলমানরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদে উপস্থিত হন। ধনী-গরীব, উঁচু-নীচু সবাই কাতারবন্দি হয়ে একত্রে নামাজে দাঁড়ান যেখানে কারো সঙ্গে কারো কোনো ভেদাভেদ থাকে না। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যকার হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা ও শ্রেণিবৈষম্য ভুলে গিয়ে এক আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জামায়াতে শরীক হন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে জামায়াতে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি সাহাবীরা মসজিদে বসে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। সুমধুর কণ্ঠে তাদের তেলাওয়াত শুনে কাফের, মুশরিক ও মদীনায় আগত পথিকরা মুগ্ধ হয়ে যেত। একবার মক্কা থেকে বনু সাকিফ গোত্রের লোকজন রাসূলুল্লাহ (সা.)’র সঙ্গে দেখা করতে মদীনায় আসে। তারা সারিবদ্ধভাবে মুসলমানদের নামাজ আদায় করতে দেখে এবং তাদের সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শুনে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং মুসলমান হয়ে যান।
মদীনার মসজিদে নববী (সা.) ছিল দ্বীনি শিক্ষা দানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। মহানবী (সা.) এখানে তাঁর শিক্ষামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের একদল একনিষ্ঠ কর্মী তৈরি করেছিলেন। এসব মোবাল্লেগ বা দ্বীন প্রচারক কুরআন ও ইসলামি ফেকাহ শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করার পর আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তেন অমুসলিমদের সামনে ইসলামের সুমহান বাণী তুলে ধরার জন্য। এসব ধর্ম প্রচারকের মুখ থেকে কালামে পাক ও হাদিসের বাণী শুনে শিরক ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন কাফিররা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করত। বিশ্বনবীর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি হওয়া এসব মোবাল্লেগের অক্লান্ত প্রয়াসে অল্পদিনের মধ্যে শুধু আরব উপদ্বীপে নয় সেই সঙ্গে আল্লাহর রাসূলের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের একটি বিশাল অঞ্চলের মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। নতুন নতুন এলাকায় স্থাপিত হতে থাকে নতুন নতুন মসজিদ। সেইসঙ্গে মসজিদকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ে তাফসিরে কুরআন, ফিকাহ শাস্ত্র, হাদিস এবং ইসলামি নৈতিকতা ও উন্নত গুণাবলী শেখার আসর।
বর্তমানেও শত্রুদের ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতা এবং ইসলাম ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার সব রকম অপতৎপরতা সত্ত্বেও অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম ও মসজিদের প্রতি আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষ শান্তির ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করছেন। ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক প্যাট্রিক ডি বাউডেন আমেরিকার জনগণের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণগুলো সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ১৩ জন নও মুসলিমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ শেষে এসব কারণ বর্ণনা করেন। ওই ১৩ নও মুসলিমের ৯ জনই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বের ঘটনার পর।
১৭ বছর বয়সি এক মার্কিন তরুণী নিজের ইসলাম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: “স্কুল ছুটির পর দুপুরে স্কুলবাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় বাতাসে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি আমার অন্তরে অন্যরকম প্রশান্তির অনুভূতি তৈরি করত। আজানের ধ্বনির মধ্যে আমি যে ভালোলাগা ও ভালোবাসার অনুভূতি খুঁজে পেতাম তা ছিল আমার কাছে একেবারেই নতুন। শেষ পর্যন্ত এই আজানই আমাকে আল্লাহ তায়ালার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করা শুরু করি এবং এক পর্যায়ে নিজের অজান্তেই নামাজ পড়তে শুরু করে দেই। একদিন আমি শিকাগোতে আমাদের বাসভবনের কাছে অবস্থিত মসজিদে যাই। সেখানে গিয়ে আমি যখন বলি যে, আমি মুসলমান হতে চাই তখন হিজাব পরিহিত একজন নারী আমার কাছে আমাকে বলেন: সুবহান আল্লাহ…। এরপর তিনি আমাকে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে যান। ইমাম সাহেব আমাকে কালেমায়ে শাহাদাতের বাণী পাঠ করান। আমি এই সুমহান বানী পাঠ করে মুসলমান হয়ে যাই। আমি সাক্ষ্য দেই, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দেই যে, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।”
বন্ধুরা! মার্কিন নও মুসলিম সম্পর্কে আলোচনার সূত্র ধরে আমরা আজ আমেরিকারই একটি মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আজ আমরা আলোচনা করব যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ওয়াশিংটন জামে মসজিদ নিয়ে। দেশটির সবচেয়ে সুন্দর মসজিদগুলোর একটি হচ্ছে ওয়াশিংটন জামে মসজিদ। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত তুর্কি রাষ্ট্রদূত মারা গেলে তার জানাযা পড়ানোর জন্য কোনো মসজিদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ কারণে মুসলমানরা তীব্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তারা ম্যাসাচুসেট অ্যাভিনিউতে ৩০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের একটি স্থানকে মসজিদ নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করেন। মসজিদটি নির্মাণ করতে সাত বছর সময় লাগে এবং ১৯৫৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনআওয়ারের উপস্থিতিতে ওয়াশিংটন জামে মসজিদ উদ্বোধন করা হয়।
ওয়াশিংটন ডিসিতে নিযুক্ত মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের আর্থিক অনুদান দিয়ে এই মসজিদ নির্মিত হয়। এসব মুসলিম দেশ শুধু আর্থিক অনুদান দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি সেইসঙ্গে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী মসজিদের এক একটি অংশ তৈরি এবং সৌন্দর্য বর্ধনের কাজেও অংশগ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এই মসজিদের টাইলসগুলো আনা হয় তুরস্ক থেকে, কার্পেটগুলো আসে ইরান থেকে এবং প্রায় দুই টন ওজনবিশিষ্ট মসজিদের লুস্টার ও ঝাড় বাতিগুলো আনা হয় মিশর থেকে।
ওয়াশিংটন জামে মসজিদের মিম্বর তৈরি হয় মিশরের রাজধানী কায়রোর ‘মোহাম্মাদআলী পাশা’ মসজিদের মিম্বরের আদলে। মিম্বরটি তৈরি হয় মিশর থেকে আনা আবলুস কাঠের ১২ হাজার টুকরা দিয়ে। এ ছাড়া, এই মসজিদে ব্যবহৃত পাথরগুলো সংগ্রহ করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অ্যালাবামা অঙ্গরাজ্যের একটি পাহাড় থেকে।
সার্বিকভাবে ওয়াশিংটন জামে মসজিদটি ইসলামি নির্মাণরীতি অনুসরণ করে মার্কিন স্থাপত্যবিদদের হাতে নির্মিত হয়। মসজিদের একমাত্র সুদর্শন মিনারটি মসজিদের মূল প্রবেশপথের উপর স্থাপন করা হয়। মিনারটির নীচের অংশ বর্গাকৃতির এবং শীর্ষের অংশ গোলাকার। নীচের বর্গাকৃতির অংশের চারদিকে রয়েছে বিশাল চারটি জানালা। এসব জানালার ইসলামি নির্মাণশৈলি দেখলেই দূর থেকে বোঝা যায় এটি একটি মসজিদের মিনার। মসজিদের ভেতরে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের জন্য রয়েছে বিশাল হলরুম। মুসল্লিরা মসজিদের দরজা দিয়ে প্রবেশের পর মরমর পাথরের তৈরি সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নীচে নেমে মসজিদের এই মূল চত্বরে প্রবেশ করেন। এই চত্বরে একসঙ্গে ১৩ হাজার মুসল্লি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের হলরুমের ছাদ স্থাপিত হয়েছে মরমর পাথরের তৈরি অনেকগুলো স্তম্ভের উপর।
যেসব মুসলমান মিলে এই মসজিদ নির্মাণ করেছেন তারা এটির সঙ্গে একটি ইসলামিক সেন্টারও স্থাপন করেন। এই সেন্টারের একদিকে সেমিনার ও আলোচনা সভা করার জন্য রয়েছে হলরুম এবং এর অন্যদিকে রয়েছে একটি বিশাল লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশ বিভিন্ন ভাষার হাজার হাজার বই উপহার দিয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী মুসলমানদের পাশাপাশি আমেরিকা ভ্রমণ করতে যাওয়া মুসলমানরা এই লাইব্রেরি থেকে তাদের জ্ঞানপিপাসা মেটান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই ইসলামিক সেন্টারের অবদান রয়েছে।
ওয়াশিংটন জামে মসজিদে প্রতিদিন হাজার হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন বর্ণের মানুষ নামাজ আদায়ের পাশাপাশি ইসলামি জ্ঞান বাড়াতে নিয়মিত এই মসজিদে যাতায়াত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোববার সরকারি ছুটি এবং এ দিন খ্রিস্টানরা প্রার্থনা করার জন্য গির্জাগুলোতে সমবেত হন। কিন্তু মসজিদে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় জমায়েত হয় শুক্রবার জুমার নামাজে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, খ্রিস্টানরা প্রার্থনা করার জন্য সাধারণত একটি নির্দিষ্টি গির্জা বেছে নেন এবং সব সময় চেষ্টা করেন ওই নির্দিষ্ট গির্জায় যেতে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য এরকম কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। আজান হওয়ার পর তারা বাসস্থান, কর্মস্থল বা অন্য কোনো স্থানে যে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন নামাজ আদায়ের জন্য নিকটস্থ মসজিদে গিয়ে হাজির হন।#