বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার রায়ে ৮ আসামির মধ্যে ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১ জনকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান ওরফে রাফিউল ইসলাম, রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ আসলাম হোসেন ওরফে র্যালশ, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান সাগর ওরফে সাগর, মামুনুর রশিদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালেদ।
আর খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। এদের মধ্যে ৭ আসামি হলি আর্টিজানে হামলা বাস্তবায়নে বিভিন্নভাবে পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী আসামিদের হামলায় যে সম্পৃক্ততা ছিল তা হল- মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আসামি রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান ওরফে রাফিউল ইসলামের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ গ্রহণ, হামলায় জড়িতদের প্রশিক্ষণ দিয়ে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও প্ররোচিত করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষক। জঙ্গিরা যে বাসা থেকে হামলার জন্য হলি আর্টিজানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল, সে বাসায় যাতায়াত ছিল তার।
২০১৪ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে পড়ার সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন রাকিবুল পরের বছর ঢাকায় চলে আসেন। মোট ছয়টি বাসায় ছিলেন। ২৭ জুলাই কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিংয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানে গুরুতর আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। মামলায় দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। জবানবন্দি অনুযায়ী গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা ছিল প্রকৃত ইসলাম কায়েমের একটি দৃষ্টান্ত।
রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ গ্রহণ, পরিকল্পনা, হামলায় জড়িতদের সহায়তা, ঘটনাস্থল রেকি, সার্বিক বিষয়ে অবগত থেকে হত্যাকাণ্ডে সহায়তার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি হলি আর্টিজানে হামলাকারী খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বলকে সরবরাহের কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ লেনদেন, হামলাকারীদের তুলে নিয়ে প্রশিক্ষকের কাছে পৌঁছে দেয়া ও বোমা ছোড়ার প্রশিক্ষণ দেয়া, ঘটনাস্থল রেকি করা ও অস্ত্র বহন করে নিয়ে আসার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার কথা সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন।
আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজের বিরুদ্ধে শূরা সদস্য হয়ে টাকা গ্রহণ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক পদার্থ সংগ্রহ, তৈরি ও সরবরাহ করার অভিযোগ প্রমাণিত। তিনি হলি আর্টিজানে হত্যাকাণ্ডে সহায়তার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি ২০০২ সালে জেএমবি ও ২০১৬ সালের মে মাসে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। মিরপুরের একটি বাসায় তামিম চৌধুরী ও বাশারুজ্জামান চকলেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। গুলশান হামলার জন্য লোক সংগ্রহ,অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। ছোট মিজান ও আসলামকে অস্ত্র বুঝিয়ে দেন তিনি।
হাদিসুর রহমান সাগর ওরফে সাগরের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠনের সমর্থন,সদস্য পদ গ্রহণ, অর্থ গ্রহণ, হামলার জন্য অস্ত্র গ্রেনেড সরবরাহ করে হত্যাকাণ্ড ঘটনানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় হামলা ও প্রস্তুতি হিসেবে টার্গেট কিলিং সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র নিজেদের জিম্মায় রেখেছিল। হলি আর্টিজানে হামলার কিছুদিন আগে তামীম চৌধুরীর নির্দেশে একটি কালো ব্যাগে করে সে চারটি গ্রেনেড ঝিনাইদহ থকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
মামুনুর রশিদ রিপন জেএমবির দায়িত্বশীল নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সারোয়ার জাহান, ডাক্তার নজরুল ও অন্যদের নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক উদ্বুদ্ধকরণ মিটিং ও সদস্য সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রাখেন। তামিম আহমেদ চৌধুরী ও সারোয়ার জাহানদের সঙ্গে মিলে আইএসপন্থী নব্য জেএমবি গঠনে যুক্ত ছিলেন। ২০১৪ সালের মে মাসে জয়পুরহাটে বৈঠক করে আইএস ভাবাদর্শ অনুসারে কাজের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া বাজার কলেজ মোড়সংলগ্ন একটি বাড়িতে অপর জঙ্গিদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকেই ঢাকার হলি আর্টিজানে হামলার প্রাথমিক পরিকল্পনা হয়। হাদিসুর রহমান সাগরের সঙ্গে তিনটি একে-২২ রাইফেল, গুলি, চারটি গ্রেনেড, দুটি ৭ দশমিক ৬২ পিস্তল ও ১২ রাউন্ড গুলি মারজানের মাধ্যমে তামিম চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেন।
আসামি শরিফুল ইসলাম খালেদের বিরুদ্ধে সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ লেনদেন, প্রশিক্ষণে সহায়তা, হামলা পরিকল্পনায় অংশ নিয়ে হামলাকারীদের যথাস্থানে পৌঁছে দেয়াসহ হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও প্ররোচিত করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল নিজ বিভাগের অধ্যাপককে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাইবান্ধায় হামলার পরিকল্পনার বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। হামলাকারীদের দলে অন্তর্ভুক্তকরণ, প্রশিক্ষণসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে তিনি।
এ ছাড়া অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান খালাস পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তিনি নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য পদ গ্রহণ ও বিস্ফোরক সরবরাহ করার দায়িত্বে ছিলেন। তবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিজান বলেছিলেন,তিনি মাছ ব্যবসায়ী। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে জামাল নামে এক ব্যক্তি তার জিম্মায় একটি বড় ব্যাগ রেখে যায়। ওই ব্যাগে বোমা ছিল বলে পরে জানতে পারেন তিনি।