স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থায় জনগোষ্ঠী যখন দিশেহারা তখন এদেশের রাজনৈতিক নেতাদের বাইরে কয়েকজন মনিষী দিকপাল হয়ে আলোকবর্তিতা নিয়ে অর্ভিভুত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে জনাব সফিকুল হক চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সংগঠিত করে তাদের অধিকার আদায় করতে প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গমন করে তাদের সচেতন করেছেন। অথচ ঐ সময়ে তিনি ছিলেন বিসিএস ক্যাডারের প্রবেশনারী অফিসার। সরকারী এমন লোভনীয় চাকুরী ছেড়ে দরিদ্র্য মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আত্ননিয়োগ করার কারণে সে সময়ের বন্ধু -বান্ধব ও আত্নীয় স্বজনদের নিকট কম তিরস্কারের স্বীকার হতে হয়নি তাঁকে। অনেকে তাঁকে ত্যাগও করেছিলেন।
এমন প্রতিকুল পরিবেশে তাঁর মহান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে অবিচল বিশ্বাস নিয়ে সাহসীকতার সাথে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আল্লাহ তায়লা প্রদত্ত নেতৃত্বের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। তাঁর মধ্যে সেই ক্ষমতা ছিল বলেই তিনি সারা জীবন আর্দশ নেতা হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে দারিদ্র্য বিমোচনে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তার নেতৃত্বে গড়ে উঠা দরিদ্র্য বিমোচনের জন্য অনন্য প্রতিষ্ঠান “আশা” আজ বিশ্বে সমাদৃত ও সর্ববৃহৎ ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান।
মহান এই নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রফেসর ডঃ ইউনুস ( ক্ষুদ্র ঋণের জনক) বলেন, “ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আশা’র প্রতিষ্ঠাতা জনাব সফিকুল হক চৌধুরী আকস্মিকভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশে এবং বিদেশের অসংখ্য গুণগ্রাহী শোকাহত। ক্ষুদ্রঋণের জগতে তিনি আকস্মিকভাবে প্রবেশ করেছিলেন। এব্যাপারে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা একাডেমিক প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু তাকে তিনি কোনো বাধা হিসাবে গ্রহণ করেননি। যে কাজের জন্য তিনি মনস্থির করেছিলেন সে-কাজে তিনি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেছেন। তাঁর সীমাহীন সাহসই ছিল তার মূল শক্তি। তাঁর সাহস, নেতৃত্ব এবং ব্যবস্থাপনার দক্ষতা তিনি দেরীতে ক্ষুদ্রঋণের কর্মকাণ্ডে যোগ দিলেও তাঁকে অতিদ্রুত দেশের সবচাইতে অগ্রগামী দুইটি প্রতিষ্ঠানের কাতারে নিয়ে যেতে পেরেছিল। তিনি শুধু দ্রুত গতিতে দেশের আনাচে কানাচে ক্ষুদ্রঋণ সম্প্রসারণ করতে পেরেছিলেন তা-ই নয়- তিনি অসম্ভব সাহস নিয়ে নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করার জন্য কল্পনাতীত রকমের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে ক্ষুদ্রঋণ সঠিক মানুষের হাতে পৌছানোর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছেন। এবং তিনি সফল হয়েছেন। দেশে ‘আশা’র মতো এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার পরেও তিনি পৃথিবীর নানা প্রত্যন্তে বিস্তৃত বহু দেশে ‘আশা’র কাঠামোতে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সংগে যৌথভাবে নানাদেশে ক্ষুদ্রঋণ পৌছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণে মোটেও উৎসাহী ছিলেন-না দেশ বিদেশের এমন বহু একাডেমিক এবং দাতা-সংস্থার নেতৃবৃন্দ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণকে তিনি ক্ষুদ্রঋণে বিশ্বাসী করে তাঁদের সহযোগী করে নিয়েছিলেন। দেশে বিদেশে তাঁর কর্মসূচির উপকারভূগী বিশাল জনগোষ্ঠী, তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত অসংখ্য কর্মীবাহিনী, পৃথিবীর নানা দেশে ছড়ানো অসংখ্য কর্মীবৃন্দ যাঁরা তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিয়োজিত আছেন, এবং তাঁর বন্ধুবর্গের সংগে তাঁর গুণমুগ্ধ হিসেবে আমিও তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করছি। সবার সংগে এক হয়ে তাঁর আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করছি। এর সংগে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা প্রকাশ করছি। তাঁর মৌলিক অবদানের জন্য দেশের সকল মানুষ তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।”
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “তাঁর মৃত্যুতে দেশের কর্মসংস্থানে ও সমাজসেবার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এনজিও বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এনজিও। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের উন্নয়নে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন মানবিক, সদা হাস্যউজ্জল ও মহৎ মনের অধিকারী। বাংলাদেশের মানবিক ও সামাজিক উন্নয়নে আশা’র সফিকুল হক চৌধুরীর অনেক বেশি অবদান আছে। তার মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত মানবিক ব্যক্তি ছিলেন। আমরা চরমভাবে ব্যথিত হয়েছি। তার মতো ভালো মানুষ খুব বেশি আসে না পৃথিবীতে।‘’
বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরল আহসান বুলবুল বলেন, “ সফিকুল হক চৌধুরী ছিলেন সহজ, সরল স্বপ্নবাজ এক মানুষ । হবিগঞ্জের, চুনারুঘাটের নিখাঁদ ভাষায় তুলে ধরতেন তাঁর স্বপ্ন ও বিশ্বাসের কথা । ফজলে হাসান আবেদের ব্র্যাক , ড. ইউনুসের গ্রামীন, কাজী ফারুকের প্রশিকা, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গনস্বাস্থ্য, খুশি কবিরের নিজেরা করির মতই সফিকুল হক চৌধুরীর ‘আশা’। আওয়াজ বা চাকচিক্য কম তবে ‘আশা’ দেশের সবচাইতে বড় বেসরকারী সংস্থা, যারা বিদেশী সহায়তা নির্ভর নয় । আশা ইন্টারন্যাশনাল ছড়িয়ে আছে বিশ্বময় । তাঁর প্রয়াণ বড় শূন্যতা তৈরি করবে । তিনি তাঁর আশা জাগানিয়া আশা’র মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।’’
সফিকুল হক চৌধুরীকে দেশে ক্ষুদ্র ঋণের অন্যতম উদ্যোক্তা উল্লেখ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “ তিনি জীবনের শুরু থেকেই দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের উদ্যোক্তা যারা আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে যারা অবদান রেখেছেন তাদের ভেতরও নিঃসন্দেহে অন্যতম তিনি। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রেখে গেছেন। তিনি ক্ষুদ্রঋণকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক উদ্ভাবনী শক্তিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য আজীবন কাজ করেছেন। গরিব মানুষের আইনি অধিকারের জন্য কাজ করেছেন। সফিকুল ইসলামের অবর্তমানে তার উদ্যোগগুলো অব্যাহত থাকবে এটা আমাদের প্রত্যাশা।’’
মোঃ জামিলুর রহমান চৌধুরী তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে বলেন “১৯৯৪ কি ৯৫ সাল হবে । আইডিবি ভবনে আশার কর্মী সম্মেলন। প্রধান অতিথি গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান । প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালীন তিনি জনাব সফিকুল হক চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলেন সরকারী চাকুরীতে থাকলে তিনি কি হতে পারতেন বা তখন পর্যন্ত তাঁর অবস্থান কি হতে পারতো । তিনি বলেছিলেন সম্ভবত সচিব হতে পারতেন । তখন মাননীয় প্রধান অতিথির মন্তব্য ছিল সচিব তো দেশে হাজারো জন আছেন কিন্তু সফিকুল হক চৌধুরী তো একজনই । উল্লেখ্য যে, বিসিএস ১৯৭৩ ব্যাচের প্রবেশনারী কর্মকর্তা হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েও চাকরিতে যোগদান না করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন এবং দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ উন্নয়ন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। জনাব সাইফুর রহমান বেঁচে থাকলে এবং আশার বর্তমান বিস্তৃতি দেখলে তিনি কি বলতেন ধারনা করা যায় ?”
তিনি শুধু দারিদ্র্য বিমোচনেই কাজ করেননি, তিনি তৈরি করেছেন দারিদ্র্য বিমোচনে নেতৃত্ব দেওয়ার মত হাজারো নেতা, যারা ইতিমধ্যে দেশ বিদেশে আশা ও আশা’র বাইরে নেতৃত্ব দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর বুনিয়াদ এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যে, এখানে অনৈতিকতা ও অস্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করার কোন সুযোগ নেই। কম সময়ে, কম খরচে কিভাবে প্রতিষ্ঠানকে আত্ননির্ভরশীল করা যায় তার নকসা ও নজির তিনিই স্থাপন করেছেন। তার কর্মময় জীবন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন বিদেশী উন্নয়ন সংস্থা ও উন্নয়নকর্মী বৃন্দ বলেন, “তোমরা ভাগ্যবান জাতি, কারণ অসহায় ও দরিদ্র্য মানুষের নেতা হিসেবে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, ফজলে হাসান আবেদ, সফিকুল হক চৌধুরীর মত নেতা পেয়েছিলে বলেই আজ তোমরা বিশ্বের দরবারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছ এবং দেশের বাইরে দারিদ্র্য বিমোচনে নেতৃত্ব দিতে পেরেছ।’’
তিনি একাধারে ছিলেন সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ। দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের মডেলের নতুন ও আধুনিক সংস্করণ তিনিই শুরু করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আশা’র মডেল আজ বিশ্বব্যাপি সমাদৃত। স্বল্প সময়ে দরিদ্র্য মানুষের মধ্যে অধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে ঋণের অধিকার তিনিই প্রথমে দিয়েছেন। সদস্য ও কর্মীদের আত্নতুষ্টির কারণে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আজ দেশে তথা বিশ্বে সর্ববৃহৎ ক্ষুদ্রঋণ প্রদান কারী এমএফআই হিসেবে আত্ন প্রকাশ করেছে। সমাজে দরিদ্র্য মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা প্রদান এবং সামাজিক স্বীকৃতি প্রদানে তার নিরলস প্রচেষ্টা ছিল অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে আজ নারীদের ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করছি তা কিন্তু বন্ধুর ছিলনা, অনেক চড়াই উৎরাই পার করতে হয়েছে এই অবস্থান তৈরি করতে। সফিকুল হক চৌধুরী এক্ষেত্রে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন। বর্তমানে এই ভুমিকা শুধু দেশেই নয়, বিশ্বেও প্রশংসিত হয়েছে।
তিনি আত্নপ্রচারে বিশ্বাসী ছিলেন না, তাই তিনি অতি নিরবে দারিদ্র বিমোচন, মানুষের কল্যান, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আজীবন কাজ করে গেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন গেছেন এমন প্রতিষ্ঠান যা দীর্ঘদিন দেশে তথা সারা বিশ্বে তার আলোকবর্তিতা হয়ে আলো ছড়িয়ে যাবে। মহান নেতার তৈরি করা অসংখ্য নেতা ও সেবক দেশে এবং সারা বিশ্বে মানব সেবা কাজ করে যাবে। তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, তৈরি করা নেতা ও সেবক এবং সেবা গ্রহণকারী লাখও মানুষের মধ্যেই তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন। উল্লেখ্য যে, সফিকুল হক চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালে, চুনারুঘাট হবিগঞ্জে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান আশা প্রতিষ্ঠাতা করেন। পরবর্তীতে তিনি আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, আশা ম্যাটস ও হোপ ফর দ্য পুওরেস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আশা ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন, তাছাড়া তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি, যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি গত ১১ ফেব্রুয়ারি’২১ দিবাগত রাত ১ঃ০০ ঘটিকায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর, মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও তিন ছেলে রেখে গেছেন। ১২ ফেব্রুয়ারি’২১ শুক্রবার বাদ জুমা রাজধানীর শ্যামলী শিশুপল্লী জামে মসজিদে সফিকুল হক চৌধুরীর জানাজা শেষে তাঁকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
লেখক: আবদুল্লাহ হারুন, উন্নয়নকর্মী।