রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ ছয় জেনারেলের বিচারের সুপারিশকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সমর্থন জানালেও চীন ভালোভাবে নেয়নি। আবার আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করার পথও জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তাই গণহত্যার বিচারের আইনি পথ যে খুব সহজ হচ্ছে না, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদন নিয়ে কেমন আলোচনা হয়, তা গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ওই আলোচনা শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গা-ঢলের এক বছরের প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিষদ এই উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করেছে।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশন গত সোমবার রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে মিশন জোরালো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাসের ভয়াবহ নৃশংসতার জন্য গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ ছয় জেনারেলের বিচার করার সুপারিশ করেছে।
নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যদেশ দ্বিধাবিভক্ত থাকায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সেই পরিস্থিতির যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনের অবস্থানে সেটা স্পষ্ট।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সেপ্টেম্বরে মানবাধিকার পরিষদে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়ার পর তা কীভাবে গ্রহণ করা হবে, সেটা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ এবং অন্য সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করব।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীজনেরা রোহিঙ্গা নিপীড়নের জন্য অভিযুক্ত লোকজনের বিচার নিশ্চিত করতে অনেক বিকল্প খুঁজে দেখছে।
যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানালেও প্রতিবেদনটিকে ভালোভাবে নেয়নি চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গতকাল বেইজিংয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, রাখাইন সমস্যার ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট যথেষ্ট জটিল। তাই একতরফাভাবে মিয়ানমারের সমালোচনা কিংবা দেশটির ওপর চাপ প্রয়োগ সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে না।
নিরাপত্তা পরিষদের তিন স্থায়ী সদস্যের দ্বিধাবিভক্তিতে এটা স্পষ্ট যে খুব শিগগির মিয়ানমার নিয়ে জাতিসংঘের কোনো জোরালো পদক্ষেপের আশা করাটা বাড়াবাড়ি।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারের জেনারেলদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কিংবা তার বিকল্প হিসেবে অস্থায়ী বিশেষ আদালতের প্রসঙ্গও এসেছে। প্রথম বিকল্প নেদারল্যান্ডসের হেগের আইসিসিতে বিষয়টি নিতে হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মতামতের প্রয়োজন। নিরাপত্তা পরিষদে যে অভিন্ন সিদ্ধান্ত হচ্ছে না, সেটা স্পষ্ট। তা ছাড়া মিয়ানমার আইসিসির সদস্য না হওয়ায় ওই আদালতে বিচার হওয়া নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিকল্প হতে পারে রুয়ান্ডা, সাবেক যুগোস্লাভিয়া, লেবানন ও কম্বোডিয়ার মতো অস্থায়ী বিশেষ আদালত। এ ধরনের আদালতের জন্য মিয়ানমারের সহযোগিতার বিকল্প নেই। জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনকে যেখানে মিয়ানমার ন্যূনতম সহযোগিতা করেনি, সেখানে এ ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচারের ব্যবস্থা করাটা খুব সহজ নয়।
আবার বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচার নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইমপার্শিয়াল অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট মেকানিজমের (আইআইআইএম) বিষয়েও বলছেন। সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আইআইআইএম গঠন করে। কাজেই সিরিয়ার দৃষ্টান্তের ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
অবশ্য আন্তর্জাতিক বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা আইসিসিতে বিচারের বিষয়টিকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। রোহিঙ্গা-ঢলের তদন্তের এখতিয়ার নিয়ে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ফাতাও বেনসুদা গত এপ্রিলে আদালতে আবেদন জানান। এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের কিংসলে অ্যাবট বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের ফল বাংলাদেশকে ভোগ করতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য। এই প্রেক্ষাপটে আদালত যদি চান, মিয়ানমারের লোকজনের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রধান কৌঁসুলি প্রাথমিক তদন্ত করার অনুমতি দিতে পারেন। তবে এ প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময় নেবে। কারণ, এতে যেমন বাংলাদেশের অংশ নিতে হবে, তেমনি মিয়ানমারেরও সন্দেহভাজনদের আদালতের কৌঁসুলির মুখোমুখি করাতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ফলে গণহত্যাসহ তিনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা নিধনের শুধু আইনি ও রাজনৈতিক মাত্রাই নয়, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। কাজেই রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার জন্য মিয়ানমারের জেনারেলসহ অভিযুক্তদের বিচারের বড় স্বীকৃতি এ প্রতিবেদন। তেমনি এটি মিয়ানমারের পক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্যও চাপ তৈরি করবে।