চীনে ৩৫ বছর ধরে চালু এক সন্তান নীতি বারোটা বাজিয়েছে বিয়ের বাজারের। গর্ভপাত, বন্ধ্যাকরণ ও ভ্রূণহত্যার হিড়িকে কনের বাজারে আক্রা। একের বর এক বর খাড়া, কিন্তু কনে নেই। বিশেষ করে ব্যাপক নারী ভ্রূণহত্যার ঘটনায় এ পরিস্থিতি। নারী-পুরুষের অনুপাত এখন নড়বড়ে। কিন্তু বিয়ে তো আর বসে থাকতে পারে না। অগত্যা হাত বাড়াতেই হচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। নিয়ে আসা হচ্ছে কিশোরী-তরুণী। গাঁটের পয়সা ঢেলে কেনা হচ্ছে কনে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৯৭৯ সাল থেকে চীন সরকার ‘এক দম্পতি এক সন্তান’ নীতি নেয়। ২০১৫ সালে এই নীতির অবসান ঘটে। এই নীতির কারণে চীনা দম্পতিরা গর্ভের সন্তান মেয়ে হলে গর্ভপাত ঘটাতেন। এ জন্য সেখানে মেয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। চায়নিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্স জানিয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে তিন থেকে চার কোটি চীনা পুরুষ বিয়ের জন্য নিজের দেশে কোনো মেয়ে পাবে না।
চীনে ঘটকদের ব্যবসা এখন রমরমা। লাওস, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া ও উত্তর কোরিয়া থেকে পাচার হয়ে চীন চলে যাচ্ছে অনেক মেয়ে। এসব মেয়ে বেশির ভাগই গরিব। একটু ভালো-মন্দ খেয়ে-পরে বাঁচার আশায় পাচারকারীদের মিষ্টি কথায় ভুলে ফাঁদে আটকাচ্ছে।
কীভাবে পাচার হচ্ছে? হুয়ং (ছদ্মনাম) নামের এক ভিয়েতনামি কিশোরী একদিন তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যায় সীমান্তসংলগ্ন শহর লাও চাইয়ে। তার বয়স তখন মাত্র ১৫। যাওয়ার সময় সে ভেবেছিল, কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। এরপরই ঘরে ফেরা। কিন্তু হুয়ং ঘরে ফিরতে পেরেছিল তিনটি বছর পর। তার বান্ধবী সেখানে একা ছিল না, তার সঙ্গে ছিল একদল যুবক। মোটরসাইকেল ছিল তাদের সঙ্গে। তারা হুয়ং ও তার বান্ধবীকে সারা শহর ঘুরিয়ে একটি পানীয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে কৌশলে মদ্যপান করায়।
দুই কিশোরী নেশাগ্রস্ত হলে এই ঘোরের মধ্যে তাদের পাচার করা হয়। চীন সীমান্তের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়ে আটকে রাখা হয়। তারা চিৎকার করে, কান্নাকাটি করে। চলে জোরজুলুম, নির্যাতন। পরে হুয়ংকে এক চীনা তরুণের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর সন্তানও হয় হুয়ংয়ের। শেষ পর্যন্ত কৌশলে স্বামী-সন্তান ছেড়ে পালিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়।
হুয়ং এখন ২০ বছরের তরুণী। বর্তমানে লাও চাই এলাকার এক বিশাল বাংলোয় থাকেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকেন ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী আরও এক ডজন মেয়ে। পাচারকারীদের খপ্পর থেকে পালিয়ে আসা এসব মেয়ে ভিয়েতনামের চীন সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করা হলেও বেশির ভাগ মেয়েকেই পাচার করা হয়েছিল বিয়ের উদ্দেশ্যে। টেডি বিয়ার আর গোলাপি-লাল বাইসাইকেলে ভরা হুয়ংদের বাসস্থানটি পরিচালনা করে আমেরিকান দাতা সংস্থা প্যাসিফিক লিংক ফাউন্ডেশন। সংস্থাটি পাচার হওয়া এসব নারীর মানসিক আতঙ্ক কাটাতে এবং শিক্ষাজীবন শেষ করতে সাহায্য করে।
পাচারকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে আসা নারী এবং ভিয়েতনামের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এই বিশাল বাণিজ্যের সামান্য অংশই শুধু প্রকাশ হয়েছে। লাও চাই শহরের এর একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর পাচারকারীদের খপ্পর থেকে ১০০-১৫০ জন ভিয়েতনামি নারী শহরটির সীমান্তদ্বার দিয়ে দেশে ফিরে আসে। অন্য সব পথে পাচার হওয়া মোট নারীর তুলনায় এ সংখ্যা খুবই সামান্য।
প্যাসিফিক লিংকের দিয়েপ ভুয়ং মনে করেন, অল্প বয়সী মেয়েরা পাচারকারীদের শিকার হচ্ছে (চীনে বিয়ের জন্য মেয়েদের ন্যূনতম বয়স হতে হয় ২০ বছর। কিন্তু অপহৃত বিদেশি মেয়েদের সঙ্গে যে বিয়েগুলো হয়, তা সব সময় সঠিকভাবে রেজিস্ট্রেশন করা হয় না)। সস্তা স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ায় সহজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে ভিয়েতনামের পাহাড়ি অঞ্চলের মেয়েদের ফাঁদে ফেলা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব করে সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে তাদের চীনের ভূখণ্ডে নিয়ে আসা হয়। প্রত্যেক মেয়ের জন্য এরা সর্বনিম্ন ৫০ সেন্ট পেয়ে থাকে। পরে দালালেরা এদের আরও চড়া দামে চীন ভূখণ্ডের ভেতরের দিকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়।
চীনের পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, হাতবদলের একদম শেষ ধাপে একজন ভিয়েতনামি নারী বিক্রি হয় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ইয়েনে (৯ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার)।
ফাঁদে পড়া বা অপহরণের শিকার নারীদের মধ্য কেউ কেউ দ্রুত বাড়িতে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। হুয়ংয়ের সঙ্গে একই বাংলোয় থাকা ১৭ বছরের একজন কিশোরী জানায়, মাত্র দুই দিনেই সে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। সীমান্তে চীনের অধিবাসী এক নারী তাকে পালাতে সাহায্য করেছিল। এক মাস আগে আরও এক চীনফেরত নারীকে দেখা যায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে। তিনি জানান, পাচারকারীরা তাকে যে ঘরে আটকে রেখেছিল, সেখান থেকে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। চীনের পুলিশ তাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে।
জি আন জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়ান কুয়নবাও বলেন, চীনের গ্রামগুলোয়, বিশেষ করে দরিদ্র অথবা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কাছে বিদেশি কনের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। গ্রামে শুধু নারী-পুরুষের অনুপাতই কনে পাওয়ার জন্য একমাত্র অন্তরায় নয়। গ্রামের মেয়েরা কাজের জন্য কিংবা সফল পুরুষদের বিয়ের জন্য শহরে পাড়ি জমায়। ফলে, গ্রামে বিবাহযোগ্য মেয়ে অনেক কমে যায়। দরিদ্র গ্রামগুলোয় কখনো কখন বিদেশি কনের সংখ্যা কয়েক ডজনে গিয়ে ঠেকে।
যে পুরুষেরা বিয়ের জন্য বিদেশি কনে কেনেন, গ্রামবাসীও কিন্তু তাঁদের প্রতি প্রায়ই সহমর্মী থাকে। ফলে, কোনো মেয়ে পালাতে চাইলে তারাও বাধা দেয়। আবার চীনা ভাষা জানা না থাকা এবং নিজেদের কাছে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় মেয়েদের জন্য পালানো সহজ নয়। অপহৃত উত্তর কোরিয়ার মেয়েরা যদি কর্তৃপক্ষকে জানায়, তাহলে পুনরায় বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটি পাচারকারীদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় চীন সীমান্তবর্তী টহল পুলিশও অপহৃত উত্তর কোরিয়ার মেয়েদের পুনরায় দেশে ফিরতে দেয় না। ভুক্তভোগী মেয়েরা একবার মা হয়ে গেলে পুনরায় দেশে ফেরা কিংবা ফেরার উপায় বের করা খুব কঠিন হয়ে যায়।
অপহৃত নারী কেনার জন্য কাউকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কঠিন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০১৫ সালে আইনে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু আইন অনুযায়ী, যেসব ক্ষেত্রে নারী ফিরে যেতে চায় এবং তার ক্রেতা বাধা দেয় না, সে ক্ষেত্রে লঘু শাস্তির বিধান রয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় পুলিশি অভিযান চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কে প্রভাব ফেলে। পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও বরাবরই শীতল।
দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে।