আমি জ্যোতিষী নই। কিন্তু আরো কমপক্ষে ৫ বছর আগ থেকে কাউকে সাংবাদিকতায় আসতে উৎসাহ দেইনি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একই রিক্সায় কখনো কখনো ৪ জন করে উঠতাম। কখনো কখনো রিক্সাচালক হঠাৎ ব্রেক করলে একজন আরেকজনের উপরে গিয়ে পড়তাম। তার মানে অল্প জায়গায় বেশি মানুষ হয়ে গেলে এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের পত্রিকা আর টেলিভিশনের সংখ্যা বা তার উপরে ভর করে থাকা মানুষদের এমন উপচে পড়া অবস্থা অনেকদিন আগে থেকেই। শুধু করোনা এসে হঠাৎ ব্রেক করে ফেলায় বাস্তব কঙ্কালদশা বেশি চোখে পড়ছে। কিন্তু শরীর থেকে চামড়া অনেক আগেই খসে পড়তে শুরু করেছে।
বেশ কয়েক বছর আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ক্লাস নিতে গিয়েছিলাম। ক্লাসের আগে শিক্ষকদের সাথে হালকা কথা হচ্ছিল। বলছিলাম, সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা নেয়া যত মানুষ বেরিয়ে আসছে, তাদের জায়গা দেয়ার অবস্থা নেই। তাদের গ্ল্যামারাস ক্যারিয়ারের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। সেদিন শিক্ষকরা অনুরোধ করেছিলেন, ক্লাসে যেন এসব কথা না বলি।
একটা দৃশ্য হয়তো সারা জীবন মনে থাকবে আমার। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে একেবারে প্রথমদিকে অনেক অভিজ্ঞ এবং বোদ্ধা লোকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এমন অনেকেই ছিলেন যারা বেশ আগে অবসরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটা সময় পরিবর্তিত কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারলেন, এভাবে হবে না। তখন ঐ অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের একের পর এক বিদায়ঘন্টা বাজতে থাকলো। সবশেষ ব্যক্তি যিনি ছিলেন, তিনি একেবারে ঘড়ি ধরে অফিস করতেন। বয়সের তুলনায় অনেক পরিশ্রম করতেন। চাকরিটা তার কাছে জীবিকার উপায় ছিল কি না জানি না। তবে সময় কাটানোর ভালো একটা উপায় যে ছিল, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
সেই লোকটাও একদিন মাথা নিচু করে বিদায় নিলেন। আমি দূর থেকে তার চলে যাওয়া দেখছিলাম সেদিন। বুকের ভেতরে কেমন যেন চিন চিন করে ব্যথা করছিল আমার।
এনটিভিতে কাজ করেছি ৫ বছর। আহ, কি অসাধারণ প্রতিষ্ঠান। কয়েক মাস আগে আমাদের সবার প্রিয় মুকুল ভাইকে বিদায় নিতে হয়েছে। সবাই তার ভূমিকার প্রশংসা করে নিশ্চই কথার ফুলঝুরি রচনা করেছিলেন বিদায়বেলায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ছাঁটাই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। প্রতিবাদ হিসেবে নিজেই চলে গেছেন।
তার চলে যাওয়ায়, অনেকেরই হয়তো সাময়িক চাকরি বেঁচেছে। কিন্তু শেষরক্ষা কয়দিন হয় বলা মুশকিল। এসব টেলিভিশন চ্যানেল একটা সময় রমরমা ব্যবসা করেছে। লাভের হিসাবের নতুন নতুন টার্গেট করেছে তারা। কিন্তু চাইলেই এনটিভির মতো প্রতিষ্ঠান বড় ইন্সটিটিউট হতে পারতো। পারেনি। কারণ, বড় প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পিতভাবে রি-ইনভেস্টমেন্ট হতে হয়। সেটা হয়নি।
আমরা মজা করে বলতাম, এনটিভি তার নিজের জায়গা ঠিক ধরে রেখেছে। কারণ, এনটিভি যতটা পড়েছে, অন্য চ্যানেল ততটা উঠতে পারেনি।
এই যে এখন প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই নিয়ে তুমুল প্রতিবাদ আর হৈ চৈ হচ্ছে। এটা নিয়ে এত হৈ চৈ হওয়াটা অতিমাত্রায় আবেগতাড়িত। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে গত কয়েকমাস ধরে এমনটা চলছে। সবকিছু যেন আশপাশ দিয়ে গেছে। আমরা কেউ কিছু বলিনি।
দোষ কার? মালিকের?
সব প্রতিষ্ঠানেই মালিকের দোষ এটা আমার মনে হয় না। কারণ, এমন অনেক টেলিভিশন বা পত্রিকা আছে যার জন্মই হয়েছে একটা স্ট্যাটাস সিম্বল বা মাসল দেখানোর জন্য। তারা ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করেনি। তাদের অগাধ টাকা আছে। একটা কর্তৃপক্ষ তৈরি করে সেই টাকা তারা তাদের উপর বিনিয়োগ করেছে। যে বিনিয়োগের আবার কোন আর্থিক রিটার্ন তারা আশা করেনি। তার মানে ব্যবসার মূল সূত্রই এখানে কাজ করেনি। যদি লাভ-ক্ষতির কড়া হিসাব থাকতো তাহলে মানুষের ব্যক্তিগত উৎকর্ষ বাড়তো, ব্যক্তির উন্নতি হতো, প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যেতো।
এটা না হওয়ার আরো বড় কারণ হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। একজন চাকরিতে ঢুকে প্রথম ৪/৫ বছর একটু একটু করে উন্নতি করতে থাকে। তারপর সেখানেই বনসাই হয়ে যায়। আমি চাকরি ছেড়েছি এই বনসাই হতে চাইনি তাই। আমি চাকরিতে থাকলে আরো ৫ বছর আরামে থাকতে পারতাম। এর বিপরীতে আমার আর কোন উন্নতি হতো না। আমিও টেলিভিশনকে আর কিছু দিতে পারতাম না।
এতকিছুর পরও আমি সব মালিককে দোষ দিতে চাই না। কারণ, আমি জানি- কিছু কিছু মালিক তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছ থেকে লাভ চায়নি। এটার জন্য টুঁটিও চেপে ধরেনি। শুধু বলেছে, নিজেদের উপার্জনের নিজেরা চলেন।
কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠান প্রধানরা অনেক সময়ই সেটা করতে পারেননি। কারণ, তাদের কোন বিজনেস মডেল নেই। চাইলে গণমাধ্যমগুলোতে কেউ খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, ক’জনের বিজনেস মডেল আছে।
লিখতে গেলে বই হয়ে যেতে পারে। সবশেষে বলি, এজেন্সীর জালে পা দেয়ায় গণমাধ্যমগুলোর ডুবে যাওয়া আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। শুধু টেলিভিশনের কথাই যদি ধরি, এমন কোন মার্কেটিং টিম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যারা সরাসরি বিজ্ঞাপনদাতার কাছ থেকে বিজ্ঞাপন আনতে পারে। অথবা এমন হতে পারে যে, বাস্তবে সে অবস্থাও নেই।
তার মানে হলো, বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রথমে বিজ্ঞাপন যায় এজেন্সীতে। সেখানে একবার কমিশনিং এর পর বিজ্ঞাপন যায় গণমাধ্যমগুলোতে। এর ফলে গণমাধ্যমের উপার্জনও রেশনিং হয়েছে।
আর শেষ কথা হলো, প্রতিবাদ করে কয়েকদিন চাকরি টিকিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না। কারণ, ঘটনা একদিনে ঘটেনি বা একদিনে এ পর্যায়ে আসেনি।
লেখক: মুনজুরুল করিম, সাংবাদিক।