পৃথিবীব্যাপী একদিকে যেমন নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা স্পষ্ট। আবহাওয়ার বর্তমান এ অবস্থা রোগবালাইয়ের বিস্তারের জন্য একেবারে আদর্শ। তবে এবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে পৃথিবীব্যাপী প্রলয়নাচন নাচছে করোনাভাইরাস। ঋতু পরিবর্তনের ফলে এ সময় সারা দিনে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা আর ধুলাবালির তারতম্যে নানা অসুখ-বিসুখের সম্ভাবনা বাড়ে, যার বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত, সাময়িক, কিন্তু অস্বস্তিকর। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা। অনেকে ভাইরাসজনিত ঠাণ্ডা-জ্বর, সাধারণ সর্দি-কাশি, টনসিলাইটিস, অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ আর্থ্রাইটিস বা বাত-ব্যথার মতো ঠাণ্ডাজনিত কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে দিনগুলো খুব কষ্টে অতিবাহিত করে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক টার্গেট হচ্ছে শ্বাসতন্ত্র, তবে একবার এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে হৃদযন্ত্র, কিডনি, লিভার, ব্রেন, রক্ত সংবহনতন্ত্র কোনো কিছুই ধ্বংস করতে বাদ রাখে না। তাই অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের শীতে একটু বেশিই সাবধান হতে হবে। সাধারণ কিছু স্বাস্থ্যসতর্কতা অবলম্বনের সঙ্গে সঙ্গে করোনাকালীন বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
করোনা থেকে বাঁচুন : করোনার সময় বয়স্ক ব্যক্তি এবং যারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট, শ্বাসতন্ত্র, কিডনি বা লিভারের রোগ, স্ট্রোক বা অন্যান্য জটিল দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। এদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাইরে না যেতে দেওয়াই ভালো। পরিবারের বাকিদের তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে হতে হবে সর্বোচ্চ সতর্ক। শীতে আমাদের দেশে এমনিতে ঘোরাঘুরি, নানা উৎসব, অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে-শাদি, সাংস্কৃতিক কাজকর্মসহ গণজমায়েত বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করুন। অন্তত তিনটি সাধারণ কাজ করলে করোনাভাইরাসের মতো ভয়ংকর দানবকে আমরা রুখে দিতে পারব- (১) নিয়মিত মাস্ক পরিধান (২) নিয়মিত কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাতকে জীবাণুমুক্ত রাখা এবং (৩) ঘরের বাইরে অন্য মানুষের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব (কমপক্ষে ৩ ফুট) বজায় রাখা।
ঠাণ্ডা যেন না লাগে : এ সময়টাতে খুব সহজেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। তাই শীত উপযোগী কাপড় পরিধান করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে, সেজন্য সকাল-সন্ধ্যায় কানটুপি, মোজা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা উচিত। ঘরের বাইরে এবং ভিতরে আলাদা জুতা/স্যান্ডেল ব্যবহার করা ভালো। প্রয়োজনে রুম হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে লম্বা সময় ধরে রুম হিটার ব্যবহার করলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। সম্ভব হলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঘর থেকে বাইরে বের না করাই উত্তম।
সাধারণ সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ড থেকে মুক্ত থাকুন : ঋতু পরিবর্তনের সময় বিশেষ করে শীতের শুরুতে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। প্রায়ই দেখা যায় দু-তিন দিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে পানি ঝরে। গলা ব্যথা করে, শুকনো কাশি থাকে, জ্বরও থাকতে পারে। এর বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত এবং অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। আলাদা কোনো চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না। গলা ব্যথা ও খুসখুসে কাশি দূর করতে গরম পানিতে একটু লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করতে হবে। গরম গরম চা বা আদা, লেবুর রস, তুলসীপাতা মেশানো গরম পানীয়, কফি কিংবা গরম দুধ বেশ কার্যকর। নাক ভালোভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে। নাক বন্ধে কার্যকর আর একটি উপায় হচ্ছে বাম বা এ-জাতীয় গন্ধযুক্ত কিছু নাকের নিচে রেখে বড় নিঃশ্বাস নিলে নাক খুলে যায়।
ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচুন : ভাইরাস মানেই যে করোনাভাইরাস তা তো নয়, স্বাভাবিকভাবে শীতে জ্বর, সর্দি-কাশিসহ নানা ধরনের ভাইরাসজনিত রোগের বিস্তার ঘটে। হাঁচি-কাশি ও সংস্পর্শের মাধ্যমে ভাইরাস একজন থেকে অন্যজনের শরীরে বিস্তার ঘটে। তাই নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করা উচিত।
অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা : শীত জেঁকে বসার আগেই হাঁপানির রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্রতিরোধমূলক ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের প্রকোপ এ সময় বাড়ে বলে রোগীদের খুব ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বাইরে না যাওয়াই উত্তম। শিশুদের অ্যাজমা প্রতিরোধে অবশ্যই ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে। আবাসস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ না রেখে মুক্ত ও নির্মল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো কারণে অ্যাজমা পরিস্থিতির অবনতি হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে।
শরীর ব্যথার কষ্ট : এ শীতে বিশেষ করে বয়স্কদের আর্থ্রাইটিস বা বাতের সমস্যা বেশি বাড়ে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, অস্টিও-আর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। এ জন্য গরম উত্তাপে থাকা ও যতটুকু সম্ভব ঘরেই হালকা ব্যায়াম করা উচিত।
শীতে ত্বকের যত্ন : শীতে ত্বকের আর্দ্রতা কমে যায়, ফলে চামড়া শুকিয়ে যায়, ঠোঁট, মুখ ও পা ফাটে। ছোট-বড় যাদের ঠোঁট ফেটে যায় তারা যে কোনো ধরনের লিপজেল বা লিপবাম ব্যবহার করতে পারেন। মুখ ও ঠোঁটে ভ্যাসলিন ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানতে অবহেলা করবেন না। একটু সতর্ক হলে শুরুতেই শীতের এসব সমস্যা সহজেই প্রতিরোধ করে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এমনকি রোগব্যাধি হয়ে গেলেও তা উদ্বেগের নয়, সহজ চিকিৎসায় নিরাময় করা সম্ভব। তবে অবস্থা সংকটাপন্ন হলে, খুব বেশি শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে।