করোনাভাইরাসের উৎপত্তির পর থেকেই বিজ্ঞানীরা নজর রাখছিলেন যে, এই ভাইরাসের জেনেটিক গঠনে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা।
সব ভাইরাসেরই জিনগত পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ এটি নিজেকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে থাকে। সাধারণত দেখা যায়, প্রতি এক মাস সময়কালে একটি বা দুটি পরিবর্তন হয়ে থাকে।
মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিবর্তন নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক ড. লুসি ভ্যান ডর্প এ বিষয়ে বলেন, টিকে থাকার জন্যই সবসময় নিজেকে বদলাতে থাকে করোনাভাইরাস। তবে বেশিরভাগ সময়ই এগুলো গুরুত্বহীন। আর দু-একটি ছাড়া বেশিরভাগ ভাইরাস রূপ বদলালেও ক্ষতিকর কিছু নেই। অনেক পরিবর্তনই ভাইরাসের আচরণে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে ভাইরাসটি এমন কিছু ধরন পাল্টিয়ে ফেলে যা তাদের টিকে থাকা এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যুক্তরাজ্য থেকে ছড়ানো করোনাভাইরাসের নতুন যে ধরন নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে, সেটি হচ্ছে– বি ওয়ান ওয়ান সেভেন অথবা ভিইউআই-২০২০১২/০১। এটির সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা অন্য প্রজাতিগুলোর চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। করোনাভাইরাসের গায়ে যে কাঁটার মতো স্পাইকগুলো থাকে- এ পরিবর্তনের ফলে সেগুলোর প্রোটিনে এমন কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, যাতে এটি আরও সহজে মানুষের দেহকোষে ঢুকে পড়তে পারছে। এটিই বিজ্ঞানীদের বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ। এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে ১৪টি মিউটেশন চিহ্নিত করা হয়েছে। ভাইরাসের মধ্যে প্রোটিন তৈরির উপাদান হচ্ছে– অ্যামিনো অ্যাসিড এবং তাতে একটি পরিবর্তন নিয়ে আসছে এই মিউটেশন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির দ্রুত ছড়াতে পারার ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলছে। এসব মিউটেশনের কথা বৈজ্ঞানিকদের আগেও জানা ছিল, কিন্তু এত বিশদভাবে জানা ছিল না।
করোনাভাইরাসের নতুন এই প্রকারটি বিজ্ঞানীরা বলছেন এটি চিহ্নিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে। কারণ সেখানে করোনাভাইরাসের ওপর নজরদারির যে বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো আছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী। এর নাম হচ্ছে কগ-ইউকে বা কোভিড-১৯ জেনোমিক্স কনসোর্টিয়াম। এত লাখের বেশি সার্স-কোভ-টু ভাইরাসের নমুনার জেনেটিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে এ ভাইরাসের যে পরিমাণ জেনেটিক সিকোয়েন্স সংরক্ষিত আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি আছে এখানে। এ কারণেই করোনাভাইরাসের নতুন কোনো রূপ বদলালে এর মধ্যে যে ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো হয়- সেগুলো এই কগ-ইউকের বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।
এ বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে যখন যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল, তখন এই বিজ্ঞানীরাই দেখতে পেয়েছিলেন যে ভাইরাসটি ব্রিটেনে আসছে মূলত ইউরোপ থেকে। সে কারণেই যে দেশগুলো করোনাভাইরাসের জেনোমিক সিকোয়েন্সিং করছে, সেসব দেশেই এর নতুন কোনো মিউটেশন হলে তারা ধরা পড়ে যাচ্ছে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস। এর মধ্যেই বিভিন্ন দেশে পৌঁছে গেছে এই নবতম করোনাভাইরাস।
যুক্তরাজ্যই একমাত্র দেশ নয়; যেখানে করোনাভাইরাসের এই নতুন রূপ দেখা গেছে। ইউরোপের ইতালি, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে এটির অস্তিত্ব। পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়াতেও। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে যেহেতু সেপ্টেম্বর থেকেই এই নতুন পরিবর্তনটি চিহ্নিত হয়েছিল, তাই মানুষের বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের সূত্রে হয়তো এর মধ্যেই এটি আরও কিছু দেশে পৌঁছে গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায়ও পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের একটি নতুন রূপ, যা হয়তো হুবহু একই রকম নয়, তবে প্রায় কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, নতুন ধরনটি কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তার একটি ধারণা হয়তো পাওয়া যেতে পারে। হয়তো দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীদের দেহে ভাইরাসটি কয়েক মাস ধরে নিরাপদে অবস্থান করেছে এবং সেখানেই এ পরিবর্তনগুলো ঘটেছে।