২০২০ সালের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার

২০২০ সালের শুরু থেকেই সমগ্র পৃথিবীজুড়ে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার আর্তনাদ যেভাবে শুরু হয়েছে, বছর শেষেও তার গর্জন থামেনি। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ মহামারি থেকে শুরু করে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে পুরো পৃথিবীতে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলন, উত্তর আমেরিকায় ভয়াবহ দাবানল, এত বেশি হারিকেনের থাবা এবং বছর শেষে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি নির্বাচন সংবাদ মাধ্যমগুলোকে ব্যস্ত করে রেখেছে।

এতগুলো ভারি সংবাদের নিচে চাপা পড়ে গেছে এই বছরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। অন্যান্য সব বছরের মতোই বিজ্ঞানের দুনিয়া কাটিয়েছে প্রচন্ড ব্যস্ত সময়। তাদের শোক ও শঙ্কিত হওয়ার মতো ফুরসতটুকু নেই। কারণ ভবিষ্যৎ সভ্যতা, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মহামারি নিয়েও তাদের ভাবতে হয়। এই বছরের এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার নিয়ে এই লেখায় সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

১. সৌরজগতের চেয়েও পুরনো কণা: আমাদের চিরচেনা সূর্য জন্ম নেওয়ার আগে একটি মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকা নক্ষত্র তার ভেতরের পদার্থগুলো মহাশূন্যে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। এরকম পদার্থের কিছু অংশ একটি উল্কায় আটকা পড়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল। উল্কাটির মাঝে অন্যান্য পাথরের সাথে মৃত নক্ষত্রের কণা একত্রিত হয়ে ১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার আকাশে প্রবেশ করে। এর নাম দেওয়া হয়েছিল মার্চিসন উল্কা।

এই উল্কাকে নতুন করে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রের কণাটি খুঁজে পেয়েছেন, যেটি ৪.৬ বিলিয়ন থেকে ৭ বিলিয়নের মাঝামাঝি পুরনো হবে। সম্পূর্ণ উল্কাটির মাত্র পাঁচ শতাংশ জুড়ে এই কণা বিরাজ করছে, যা দৈর্ঘ্যে আট মাইক্রোমিটারের কাছাকাছি হবে। অর্থাৎ, এটি মানুষের চুলের প্রস্থের চেয়েও ছোট। পরিমাণে তা অতি সামান্য হলেও বিজ্ঞানীদেরকে তা নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। আমাদের গ্যালাক্সির ইতিহাস বুঝতে এই ক্ষুদ্র কণাটি সাহায্য করতে পারে।

২. ডায়নোসরের ভ্রুণ : গবেষকরা টির‍্যানোসর ডায়নোসরের ভ্রুণের কিছু অংশ শনাক্ত করতে পেরেছেন। তবে এই ভ্রুণগুলো দুটি ভিন্ন জায়গায় খুঁজে পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে কানাডার অ্যালবার্টাতে ভ্রুণের ভেতরে অপরিপক্ব ডায়নোসরের পায়ের থাবা পাওয়া গিয়েছিল। এর আগে ১৯৮৩ সালে মন্টানায় নিচের চোয়াল পাওয়া গিয়েছে। বিশ্লেষণে বের হয়েছে, ভ্রুণগুলো ৭১ থেকে ৭৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো। এই বছরে বিজ্ঞানীরা এগুলোকে ভ্রুণ হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই আবিষ্কারের ফলে জানা গেছে টির‍্যানোসররা বিস্ময়করভাবেই অনেক ছোট আকারে জন্ম নেয়, যার দৈর্ঘ্য প্রায় তিন ফুট। চিহুয়াহুয়া প্রজাতির কুকুরের আকার হলেও তাদের বেশ লম্বা লেজ ছিল। অবশ্য এই আকারটি একটি পরিপূর্ণ টির‍্যানোসরের দশ ভাগের এক ভাগ। এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা এখনো অন্য কোনো ভ্রুণ খুঁজে পাননি কেন সেই রহস্যের একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তা হচ্ছে, বেশিরভাগ গবেষকই এত ছোট আকারের ডায়নোসর খোঁজার চেষ্টা করেননি।

৩. ত্রিমাত্রিক প্রোটিন কাঠামো শনাক্তকরণ: প্রাণীদেহের জিন ডিএনএ দিয়ে গঠিত, যেখানে প্রোটিন এনকোড করা থাকে। সম্পূর্ণ প্রাণীজগতই প্রোটিন দিয়ে তৈরি। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক কোড পড়তে পারেন এবং তা থেকে একটি সাধারণ প্রোটিনের কোড অনুবাদও করতে পারেন। কিন্তু প্রোটিন ত্রিমাত্রিকভাবে অনেকগুলো গুচ্ছে ভাঁজ করা থাকে। এগুলোকে একত্রে এনজাইম বলা হয়। বিজ্ঞানীরা জিন থেকে যে প্রোটিন অনুবাদ করেন, সেটি দ্বিমাত্রিক। ত্রিমাত্রিকভাবে একে বুঝতে পারলে পরিপূর্ণভাবে তার কার্যকারিতা বোঝা সম্ভব।

গত নভেম্বরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ডিপমাইন্ড এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের আলফাফোল্ড প্রোগ্রাম প্রোটিন কাঠামো শনাক্তের অন্য সকল কৌশলকে হারিয়ে দিয়েছে। এটা এক চমকপ্রদ সাফল্য। ঔষধ ডিজাইন করা কিংবা কোনো প্রোটিন কীভাবে কাজ করে এই ধরনের সকল ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক স্পেসে প্রোটিনকে বুঝতে পারা একটি বড় বাধা ছিল। তবে এটি যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি সমাধান, গবেষকরা এখনও পুরোপুরি প্রক্রিয়াটি বুঝতে পারেননি। তবে তা বোঝার পথটি পরিষ্কার হয়েছে।

৩. ল্যাবে উৎপন্ন মাংস: এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯ বিলিয়ন স্পর্শ করবে। এত বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য জীববৈচিত্র্য ধ্বংস না করে, প্রয়োজনীয় পুষ্টি গুণাগুণ সমৃদ্ধ খাবারের যোগান কোথা থেকে আসবে? ইতিমধ্যেই মুরগি এবং টার্কির মধ্যে যে পরিমাণ বায়োম্যাস, তা অন্যসব পাখিকে ছাড়িয়ে গেছে। যেসব প্রাণী আমরা খাই, তাদের বায়োম্যাস বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় দশগুণ বেশি।

এই সমস্যা সমাধান করতে হলে খাদ্যবিজ্ঞানে উদ্ভাবন প্রয়োজন। তবে কিছু সম্ভাব্য পদ্ধতি নিয়ে এর আগে কাজ হয়েছে। পোকামাকড়কে উচ্চপ্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারে রুপান্তর করা এমন একটি প্রচেষ্টা। ২০১৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার এক কোম্পানি ভেজিটেবল প্রোটিন থেকে কৃত্রিম মাংস তৈরি করেছে। তারা সেসময় থেকেই এই মাংসের বার্গার বিক্রি করে আসছে। কিন্তু মাংসপ্রিয় মানুষের রুচি পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি এই বার্গার।

বায়োকেমিস্টরা এই বছরে চমৎকার একটি উপায় দেখিয়েছেন। প্রাণীর দেহের কিছু কোষ নিয়ে উপযুক্ত পরিপোষক পদার্থ দিয়ে সেখানে মাংস উৎপন্ন করা সম্ভব। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ ‘ইট জাস্ট’-এর প্রস্তুত করা এরকম ‘কালচারড’ মাংসকে সিঙ্গাপুরের ফুড রেগুলেটরি এজেন্সি অনুমোদন দিয়েছে। এই ধরনের মাংসের বিকল্প আমাদের খাদ্যাভ্যাসে স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। এই পদ্ধতির আবার বাস্তুসংস্থানগত উপকার রয়েছে। ফ্যাক্টরিতে প্রাণীদেরকে যেভাবে বড় করা হয়, এটা অনেকেই অনৈতিক হিসেবে বিচার করে। সেক্ষেত্রেও ল্যাবে তৈরি মাংস একটি বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

৪. কক্ষ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টর: প্রথমবার যখন বিদ্যুৎশক্তিকে মানুষ বশে আনতে পেরেছিল, সে সময় থেকেই একটি বড় লক্ষ্য ছিল কক্ষ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টর তৈরি করা। সুপারকন্ডাক্টর এমন পদার্থ যেখানে রোধের পরিমাণ তাত্ত্বিকভাবে শূন্য। অর্থাৎ, বিদ্যুৎশক্তির সম্পূর্ণটাই সেখানে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু শুধুমাত্র প্রচন্ড ঠান্ডা তাপমাত্রায়ই পদার্থগুলো অসাধারণ এই বৈশিষ্ট্যটি প্রদর্শন করে, সাধারণত যা কক্ষ তাপমাত্রার থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।

গত অক্টোবর মাসে, রোচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো একটি গবেষণা দল কক্ষ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টরকে স্থিতিশীল করতে পেরেছে। এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন রঙ্গ দিয়াস। মিখাইল ইরেমেটসের নেতৃত্বে, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর কেমিস্ট্রির একটি দল এর আগে এটি নিয়ে গবেষণা করেছিল। রঙ্গ দিয়াসের দল সেই গবেষণার উপরে কাজ করে এই অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে।

কার্বন, সালফার ও হাইড্রোজেনের একটি যৌগকে ২৭০ গিগাপ্যাসকেল চাপ দিয়ে সুপারকন্ডাক্টরে রুপান্তর করা হয়েছে। এরকম প্রচন্ড চাপ দিয়ে যে সুপারকন্ডাক্টর তৈরি করা হয়েছে, সেটির ব্যবহারিক প্রয়োগ এখন নেই বললেই চলে। কিন্তু ভবিষ্যতের গবেষণার জন্যে এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। পরবর্তীতে আমরা অনেক কম চাপে কক্ষ তাপমাত্রার সুপারকন্ডাক্টর তৈরির আশা করতেই পারি।

৫. সূর্যের নিকটবর্তী ছবি: গত জুলাই মাসে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও নাসা সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান সোলার অরবিটার নামে একটি মিশন পরিচালনা করেছে যেখানে সূর্যের ৪৮ মিলিয়ন মাইল দূরে থেকে এই ছবিটি তোলা সম্ভব হয়েছে। এই ছবিতে সূর্যপৃষ্ঠের কাছে বিজ্ঞানীরা একধরনের শিখা শনাক্ত করেছেন যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্যাম্পফায়ারস’। সূর্যপৃষ্ঠের বাইরের তাপমাত্রা তার পৃষ্ঠের তুলনায় বেশি কেন সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো এই শিখার মধ্যে লুকিয়ে আছে।

সোলার অরবিটার প্রজেক্টের একজন বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল মুলার আশা প্রকাশ করেছেন, তারা বুধ গ্রহের চেয়েও সূর্যের নিকটবর্তী ছবি নিতে পারবেন। এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট ইমেজার নামের একটি যন্ত্র দিয়ে এই ছবি নেওয়া সম্ভব হয়েছে। সোলার অরবিটারটি তখন পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্বের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করছিল। আশা করা যাচ্ছে, এই মিশনটি সূর্যের অনেকগুলো রহস্যের উত্তর দিতে পারবে।

৬. প্রথম এম-আরএনএ ভ্যাকসিন: এই ডিসেম্বর মাসে, যুক্তরাজ্য যখন আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট ফাইজারের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দিল, এটি পশ্চিমের সবচেয়ে দ্রুত অনুমোদন পাওয়া ভ্যাকসিনে পরিণত হলো। ভ্যাকসিনটির প্রস্তুতিকাল ছিল মাত্র দশ মাস। এর আরেকটি রেকর্ড রয়েছে। সেটি হচ্ছে, এম-আরএনএ প্রযুক্তির উপরে নির্ভর করে তৈরি হওয়া এটাই প্রথম ভ্যাকসিন। জার্মানির বায়োটেক ফার্ম বায়োএনটেকের সাথে ভ্যাকসিনটি তৈরিতে ফাইজার কাজ করেছে।

ফাইজার দাবি করছে, ভ্যাকসিনটি ৯৫ শতাংশ কার্যকর। ভ্যাকসিনটিতে ভাইরাসের একটি জেনেটিক কোডিং অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেটি একটি কেসিংয়ের মধ্যে করে আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো হবে। অ্যান্থনি ফাউচির মতো বিশেষজ্ঞরা এত দ্রুত প্রস্তুত করার পরেও ভ্যাকসিনটির ব্যাপারে শঙ্কিত না হতে অনুরোধ করেছেন। সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উন্নতি ও ভ্যাকসিনটি প্রস্তুতিতে বিশাল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের ফলেই এত দ্রুত এটি প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। এক বছরের কম সময়েও ভ্যাকসিন প্রস্তুতি, অনুমোদন এবং তা বাজারজাতকরণ এক বড় ধরনের সাফল্য, যেটি একসময়ে অসম্ভব ছিল।

শেয়ার করুন