শুক্র শনি রবি তিনদিন টানা ছুটি। ছুটির কথা মনে হতেই মন ছুটে যেতে চায় প্রকৃতির নিসর্গে। কবীর আমার সেই ইচ্ছার ছাইয়ে ঘি ঢেলে দিল। সিদ্ধান্ত নিলাম এই ছুটিতে ছুট দেব। বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। তারপর কলাবাগান থেকে বাস ধরলাম লংগদু’র উদ্দেশ্যে। বাসে বসে কবীর জিজ্ঞেস করলো- লংগদুতে দেখার কি আছে? আমি বললাম সব আছে। কবীরের চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল, জিজ্ঞেস করল-ওখানে কি পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মেঘ ছোঁয়া যায়? আমি বললাম- না। আমার না বলাতে কবীরের খুশিতে যেন কিছুটা ভাটা পড়ল। আমি বললাম- খোলা আকাশ আছে, উচু নিচু ঢেউ খেলা পাহাড় আছে, সবুজ বনানী আছে আর আছে বিস্তীর্ণ হ্রদ। চলবে না এতে? আমার প্রশ্নের জবাবে এবার কবীরের ঠোঁটে হাসি দেখা গেল।
লংগদু সম্পর্কে একটু বলে নিই, তা হলো লংগদু রাঙামাটির একটি উপজেলা। তবে জেলা সদরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। ঢাকা থেকে সরাসরি লংগদু যেতে হলে খাগড়াছড়ি হয়ে যেতে হবে। আমারাও যাচ্ছি সেই পথে। রামগড়, মাটিরাঙ্গার পাহাড়ি আঁকা বাকা পথ পার হয়ে বেলা এগারোটায় আমরা খাগড়াছড়ি পৌঁছলাম। সেখান থেকে আরো তিন ঘন্টার একই রকম পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম লংগদু সদরে। পাহাড়ি এই পুরোটা পথই বৈচিত্রপূর্ণ, যে কারণে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি ভুলে ডানে বামে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাহাড়-সমতলের সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। বাস আমাদের নামিয়ে দিল বাইট্টাপাড়া নামের এক বাজারে, সেখান থেকে মটর বাইকে চেপে পাঁচ মিনিটের পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম লংগদু লঞ্চঘাটে। ঘাটের পল্টুনে দাঁড়াতেই স্বচ্ছ পানি ছুঁয়ে আসা বাতাসের ঝাঁপটা আমাদের স্বাগত জানাল। আমরা রাস্তার সমস্ত ক্লান্তি ভুলে চনমনে হয়ে উঠলাম।
লংগদু উপজেলা সদর হলেও খুব ছোট একটা জনপদ। প্রয়োজনীয় সরকারী অফিসের বাইরে তেমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই। আমরা লংগদুতে পৌঁছলাম শুক্রবার দুপুর ২টায়, শুক্রবার হওয়ায় আরো নিরিবিলি ছিল ঐ ছোট বাজারটা। লেকের পাড়েই একটা রেস্টেুরেন্টে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। অনেকেই ওটাকে রেস্টুরেন্ট বলতে চাইবেনা। কেননা চারচালা একটা ঘর যার দেয়াল বাঁশের চাটাই দিয়ে তৈরি, তাও আবার তা কালো হয়ে গেছে। কিন্তু রান্নাটা চমৎকার। বেয়ারা এসে খাবারের আইটেম বলতেই আমি বললাম- মাছ ভাত খাব। যা ভেবেছিলাম তাই, কাতলা মাছের মোটামুটি সাইজের একটা টুকরো। স্বাদ মন জুড়ানো। বেয়ারা জানালো লেকের মাছ তাই এতো স্বাদ। আসার সময় বাবুর্চিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এলাম। হোটেলে খেতে খেতেই একটা বিষয় বেশ খেয়াল করলাম যে স্থানীয় বাঙালিরা বেশ ধর্ম অনুরাগী। হোটেলে মহিলাদের খাওয়ার জায়গা পর্দা দিয়ে আলাদা করা হয়। মানে মহিলারা যখন খেতে বসে তখন সিলিংয়ের সাথে ঝুলানো পর্দাগুলো খুলে তাদের ঢেকে দেওয়া হয়।
যাই হোক খাওয়া দাওয়া শেষে লঞ্চ টার্মিনালে এসে দাঁড়ালাম। লেকের ওপাশের পাহাড় হাতছানি দিচ্ছে। তার পায়ের কাছে এক গ্রাম, যাব সেইখানে। সামনে টলটলে পরিষ্কার পানিতে ঢেউগুলো রোদ লেগে চিক চিক করছে। আমরা একটা ইঞ্জিন বোটে উঠে বসলাম। বোট চলা শুরু করল, আমরা বাতাসে চনমনে হয়ে উঠলাম। কিন্তু এই চনমনে ভাব আর বেশিক্ষণ থাকল না। লেকের মাঝামাঝি হতেই বাতাসের গতি ভীষণ তীব্র হলো। নদী হয়ে গেল সাগর, আকাশ কালো হয়ে এল ঘন মেঘে, সাথে বৃষ্টি। টলতে টলতে আমরা পৌঁছলাম ওপারের গ্রামে। তখন ভয় আমার ভেতরে এক রকম দানা বেধে উঠেছে। কিন্তু গ্রামের রূপ দেখে মুগ্ধ হলাম। ইট বিছানো রাস্তার সাথেই স্বচ্ছ পানির আয়না। একটু এগিয়ে স্থানীয় বাজার, সেখানে গিয়ে স্থানীয় তরুণদের সাথে পরিচিত হওয়ার পর কথা বেশ জমে উঠল। কথায় কথায় এক তরুণ আঙ্গুল দিয়ে দেখাল- ঐখানে গতকাল রাতে হাতি এসেছিল। আমি চমকে উঠলাম, সর্বনাশ। আমি লংগদুতে যাবার আগে যতটুকু পড়েছিলাম তাতে জানতাম ওখানে আরো কিছুটা দূরে হাতিদের আবাস। কিন্তু এখন তো হাতির ডেরায় এসে হাজির। ভয় আরো জমে উঠল। এ্যাডভাঞ্চার ভালো, কিন্তু বিপদ ডেকে আনা ভালো না।
আমরা একজনের পরিচয়ের সূত্র ধরে এক বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম। সুন্দর চকচকে ঝকঝকে বাড়ী। মাটির একটা ঘর, অন্যপাশে বাঁশের চাটাই দিয়ে তৈরি একটা ঘর। হাস মুরগি, গরু ছাগল সবই আছে বাড়ীতে। অর্জুন, আমলকি, ছাতিম, বহেরাসহ নাম না জানা অনেক গাছে ঘেরা বাড়ির চারপাশ। তার ঢালে স্থির হয়ে আছে স্বচ্ছ পানি। আমরা বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়েছিলাম, তাই ব্যাগ রেখেই স্নানে নেমে গেলাম। পানিতে নেমে দেখলাম পানি একটু গরম গরম, পানির এই হালকা ওম খুব চমৎকার লাগল। স্নান সেরে ঘরে এসে দেখি আমাদের জন্য চা নাস্তা রেডি। তখন একটা কথা মনের ভেতরে ভীষণ বেজে উঠল, বাঙালির মতো অতিথি পরায়ণ আর কেউ হতে পারে না। সত্যি বলতে কি ঐ সামান্য সময়ের পরিচয়ে তারা আমাদের দুটো দিন যে সমাদর করেছে তা কোনদিন ভুলবো না। চা খেয়ে আমরা গ্রামের সাথে পরিচিত হতে বের হলাম। গ্রামের নাম আমাদের জিভে ঠিক মতো এলো না। আমি বলতাম শিবাডাঙ্গা। ওরা কিভাবে যেন বলতো, শুনতে লাগত শিবারাগা/ শিবের আগা।
বনই জনপদ, জনপদই বন। সেই বন পেরিয়ে আমরা চাকমা পাড়ায় পৌঁছলাম। বাজার বলতে দু-তিনটে দোকানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেবল পাওয়া যায়। চাকমা যুবক বৃদ্ধদের সাথে আমাদের গল্প বেশ জমে উঠল। স্থানীয় বাঙালি চাকমাদের মধ্যে খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক চোখে পড়ল। আমরা এক সাথে চা সিগারেট খেলাম। তাদের জীবনযাত্রা, কাজকর্ম ইত্যাদি নিয়ে কথা বার্তা হলো। কথায় কথায় প্রসঙ্গ চলে আসল হাতির। হাতি ফসল খেয়ে নেয়, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব গল্পের মধ্যে দিয়ে আমার ভেতরে এক হাতি ফোবিয়া তৈরি হয়ে গেল।
চাকমা পাড়া থেকে হেঁটে গেলাম এক বাঙালি পাড়ায়। আকাশে হালকা মেঘ। চাঁদের আলো কখনো পরিষ্কার হচ্ছে, কখনো মেঘে ঢাকা পড়ছে। আলো আধারিতে বড় বড় গাছগুলো এক ভৌতিক আকার নিয়েছে। আর আমার চোখে তখন ভয়, এই বোধ হয় গাছের ওপাশ থেকে বিশাল এক হাতি বেরিয়ে এলো। নূর মোহাম্মদ এলাকার একজন সাহসী যুবক। সে আমাদের নিয়ে আড্ডা জমিয়ে দিল। ছাতিম ফুলের তীব্র ঘ্রাণ, ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, আকাশে চাঁদ, তারা, মেঘ আর নূর মোহম্মদের হাতির মুখোমুখি হবার ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা মিলে মনে হলো বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড়ে ডুবে আছি। সে রাতে আমরা বেশি সময় বাইরে থাকতে পারলাম। কেননা, রাতের খাবার খাওয়ার জন্য গৃহকর্তার বারবার ফোন আসছিল। রাতে বাড়িওয়ালা মুরুব্বী কাকার কাছে অনেকক্ষণ পাহাড়ের গল্প শুনলাম। কাকা কথায় কথায় জানালেন এখানে কোন সমস্যা নেই, শুধু ঐ হাতির ভয়। আবার আমি চমকে উঠলাম- এই বুঝি হাতি ঘরের দরজায় হাজির।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম সকালের সোনালী আলো গাছগাছালি আর লেকের পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা তড়িঘড়ি নাস্তা সেরে শিবাডাঙ্গার প্রকৃতি দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। স্থানীয় তরুণ ওয়াসিম, তোফাজ্জেল, মফিজুলের সাথে ততক্ষণে আমাদের ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। তারা আমাদের শাপলার বিলে নিয়ে গেল। অসংখ্য শাপলা ফুল ফুটে আছে চারদিকে। লেকের স্থির পানি আয়নার মতো। মনে হচ্ছে সেই আয়নায় শাপলা ফুলগুলো প্রতিনিয়ত তাদের মুখ দেখে। পানির নিচে শেওলা ও জলজ গাছগুলো দুলছে। কিছু নাম না জানা পাখির কাছাকাছি হতেই পাখিগুলো উড়ে গেল। আমরা বেশিক্ষণ নৌকায় থাকতে পারলামনা। কারণ, রোদের তীব্রতা ক্রমে বাড়ছিল। আমরা নৌকা থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। এই পায়ে হাঁটা পথের দুধারে ঘন জঙ্গল, মাঝে মাঝে ছড়ানো ছিটানো ভাবে দেখা যাচ্ছে চাকমাদের বাড়ি। সেখানে ছোট ছোট শিশুরা অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গৃহিনীরা তাদের নিজ নিজ কাজে মনোযোগি। এক চাকমা বাড়িতে আমরা আলাপ করতে ঢুকতেই বাড়ির বৃদ্ধ মহিলা জানতে চাইল আমরা রোহিঙ্গা কিনা। আমাদের সাথে যে স্থানীয় তরুণরা ছিল তারা বোঝাতে সক্ষম হলো যে আমরা রোহিঙ্গা না। আমাদের মধ্যে থেকে একটা ছেলে একটা চাকমা শিশুকে কোলে নেবার চেষ্টা করতেই শিশুটি ভীষণ চিৎকার জুড়ে দিল। তার মা আমাদের জানাল, আমাদের রোহিঙ্গা ভেবে শিশুটি ভয় পেয়েছে। (ঐ সময় রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আসছিল এবং এটা নিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্টির মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল) যাই হোক বৃদ্ধ মহিলা ভাঙ্গা বাংলায় তার কিছু গল্প শোনাল। আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে আবার চলতে শুরু করলাম, সাথে হাতির ভয়। কবীর সবার আগে আগে যাচ্ছে, হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল। আমি ভাবলাম বোধ হয় সামনে হাতি। পেছনে দৌড়াব কিনা এমনটা ভাবছি। এমন সময় শুনি একটা বড়সড় সাপ কবিরের সামনে দিয়ে নিচে নেমে গেল। কবীরের আবার সাপের ভয় ভীষণ। ভয় আর আগ্রহ নিয়ে আমরা পৌঁছলাম টিলার শেষ প্রান্তে। সেখানে ছোট একটা নদীর কাছে এসে পথটা শেষ হয়ে গেছে। নদীর ধারে বসে পাহাড়ের প্রকৃতি উপভোগ করলাম। দূরে অনেক উঁচু পাহাড় আমাদের হাতছানি দিচ্ছে, সেখানে রোদ্দুর ছায়ার খেলা চলছে। পলকহীন এই দৃশ্য যখন দেখছি তখন নুর মোহাম্মদ ফেরার তাড়া দিল। কেননা বিকেলে যেতে হবে হাতির আসল ডেরায়।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে তিন চারটা বাইক নিয়ে আমরা ৮-১০জন রওনা হয়ে গেলাম হাতির ডেরায়। লোকালয় ছেড়ে যত জঙ্গল ঘন হচ্ছে তত পাহাড়ি পথ উঁচু নিচু হচ্ছে, আঁকা বাকা হচ্ছে। কোথাও কোথাও লেক দেখা দিচ্ছে এবং লেকের পানি আর রাস্তা সমান হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমাদের বাইকগুলো পানির উপর দিয়েই চলেছে। আমি সামনে এবং দুপাশেই তীক্ষ্ণ নজর রাখছি। বলা যায় না জঙ্গল থেকে হাতি যদি বের হয়ে এসে আমাদের পথ আটকায়, তখন কী উপায় হবে? এসব ভাবতে ভাবতে আমরা প্রায় মিনিট চল্লিশেক চলার পর আমাদের রাস্তা একটা পাহাড়ের কাছে এসে থমকে গেল। ওখানে রাস্তাটা এতোটাই খাড়া এবং পিচ্ছিল ঢাল যে, ঐ ঢাল বেয়ে বাইক নিয়ে ওঠা সম্ভব না। আমরা বাইক নিচে রেখে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের উপরে উঠে গেলাম। পাহাড়ের উপরে উঠে পেছন ফিরে তাকাতেই আমার সব ভয় দূর হয়ে গেল। পেছনের দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। কি অপূর্ব সে দৃশ্য! বলে বোঝাবার মতো নয়। কাপ্তাই লেকের বিশাল এলাকা ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে। একদিকে মেঘ জমেছে, অন্য দিকে বিকেলের রোদের প্রতিফলন হচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো জেগে আছে জনপদ বাজার। কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বৃষ্টি এসে আমাদের ভিজিয়ে দিল। আমার ভয় বেড়ে গেল ভীষণ, বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তায় ফিরবো কী করে? তার ওপর সাথে আছে বাইক। আমরা সেই খাগড়াছড়ি পাহাড়ে কিছু সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার মুখোমুখি ফেরার পথ ধরলাম।
ফেরার পথে কয়েকবার স্লিপ খেয়ে পড়েও গেলাম। কিন্তু মনকে বললাম দমলে চলবে না। অন্ধকার ঘন হবার আগেই ফিরতে হবে। বাইকের চাকা কাদায় আটকে যাচ্ছে তবু সবাই সর্বশক্তি দিয়ে বাইক চালাচ্ছে। পথে চোখে পড়ল হাতির বিষ্ঠা। আমি তো চমকে উঠলাম, ওরে সব্বনাশ! হাতি তো তাহলে আশে পাশেই আছে। আমি দ্রুত ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। হাতিগুলো যে এলাকা দিয়ে চলাচল করে ঠিক সেখানে এসেই বাইক কাদায় একদম আটকে গেল। আপাতত কাঠি দিয়ে কাদা ছড়ানো ছাড়া উপায় নেই। আমি প্রচন্ড ঘামছি, কবীর ক্যামেরা ঠিক করছে। যেন অন্ধকারে ও দুয়েকটি ছবি নিতে পারে। আমরা বাইক রেডি করেছি, ফিরব এমন সময় কবীর সেখানে সিগারেট ধরিয়ে সময় পার করতে চাইল। খুব সাহস নিয়ে কবীর বলল এতো দুরে এসে হাতির ছবি না নিয়ে ফিরতে মন চাচ্ছে না ভাই। অগত্যা কী আর করা। হাতি দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিচ্ছুক্ষণ পর জঙ্গলের মধ্যে থেকে হাতির একটা ডাক আসতেই কবির স্যান্ডেল ফেলে দৌড়। সেই দৌড় দৌড় করতে করতে আমরা শিবাডাঙ্গা এসে পৌঁছলাম। পৌঁছে যেন জানে পানি পেলাম।
আমরা শিবাডাঙ্গা পৌঁছে দেখি আমাদের হাঁটু পর্যন্ত কাদায় একাকার। আমরা এক জায়গায় পানিতে নেমে কোন রকম ধুয়ে একটু ভদ্রস্থ হলাম। আকাশে হাল্কা মেঘ, চাঁদের আবছা আলোয় স্থানীয়দের সাথে চায়ের আড্ডা বেশ জমে উঠল। ওদিকে নুর মোহাম্মদ এবং ওয়াসিম আমাদের জন্য এক টিলায় রাতের খাবারের আয়োজন করেছে। ছোট ছোট দুটো নৌকায় করে আমরা চলেছি নুর মোহম্মদের সেই টিলায়। চারিদিক স্তব্ধ, কেবল নৌকার বৈঠার ছপ ছপ শব্দ আসছে। আমাদের সাথে চাঁদটাও চলেছে। কখনো গাছের ঘন অন্ধকারে আড়াল হয়ে যাচ্ছে চাঁদ, সেখানে দেখা যাচ্ছে জোনাকি মিটমিট করে জ্বলছে। ঐ মুহুর্তটা মনে হচ্ছিল কোন একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে টিলাতে গেলাম সেখানে শশা আর করলা ক্ষেতের পাশে ছোট একটা ঘর। সেই ঘরে রান্না হলো, খাওয়া দাওয়া হলো আর পাহাড় সমতলের নানা গল্প হলো। গভীর রাতে হৃদয়বিদারক পরিবেশ তৈরি হলো। কেননা, পরদিন সকালে আমাদের আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। তাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। দুটো দিনেই সকলের সাথে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে। বিদায়বেলায় সকলের মন খারাপ হয়ে গেল। নুর মোহাম্মদ সেই রাতে নৌকার ছপ ছপ দাঁড় বেয়ে আমাদেরকে ওয়াসিমের বাড়ীতে নিয়ে গেল। আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে ফিরতে ফিরতে সেই হাতির ভয় আমার মধ্যে আবার জেগে উঠল।
পরদিন ঝলমলে এক সকাল, সেই সকালে আমরা ঢাকার পথ ধরলাম। নাগরিক জীবনে এসে সেই ছবিগুলো বারবার চোখে ভাসতে থাকল। দু’দিন পরে খবর পেলাম আমরা যে ঘরটাতে ছিলাম, সে ঘরটা হাতি এসে ভেঙ্গে দিয়েছে।