গিয়েছিলাম নরকের দুয়ারে। ঘাবড়াবেন না! নাম তার Hells Gate. কিন্তু স্বর্গে গেলেও বুঝি এরকম সব দৃশ্যই দেখতে পাওয়া যাবে। দম আটকে যাওয়া সৌন্দর্য আর অনেক অনেক উত্তেজনাকর মুহূর্তের সমন্বয়ে ঘুরে এলাম কেনিয়ার নাইভাশাতে হেলস গেট ন্যাশনাল পার্ক এন্ড জিওথারমাল প্ল্যান্টে।
কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে যেতে যেতেই পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত নাইভাশা লেকের অদূরে হেলস গেট ন্যাশনাল পার্কে। কেনিয়াজুড়ে ২৪টি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে এটি তুলনামূলক ছোট। কিন্তু এটি দ্বিতীয় পার্ক যেখানে ক্যাম্পিং, সাইক্লিং, বাইকিং কিংবা হেঁটে ঘুরে বেড়ানো যায় বন্য প্রাণীর দ্বারা কিংবা অন্য কোন বিপদের সম্ভাবনা ছাড়াই। খাড়া গিরিখাত, গরম পানির স্রোতের ঝর্ণা, আগ্নেয়গিরি, রিফট ভ্যালির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, মাসাই সংস্কৃতি আর অভয়ারণ্যে জেব্রা, গেজেল, আফ্রিকান বাফেলো, বেবুন ইত্যাদি বন্য প্রাণীর ঘোরাঘুরি দেখতে দেখতে একটা দিন কীভাবে যে কেটে যাবে তা টেরও পাওয়া যায়না।
এই ট্রিপের প্রতিটি পদে পদে উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে। চাইলে সাইক্লিং করা যায়, পাথুরে পাহাড়ে ক্লাইম্বিং করা যায় কিংবা শুধুই হেঁটে হেঁটে আস্বাদন করা যায় পরম সৌন্দর্য। মাসাই জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি জানা কিংবা হাতের কাজ দেখার সুযোগও রয়েছে পার্কের ভেতর। চাইলে তাদের তৈরী রঙীন সব হস্তশিল্পের কেনাকাটারও ব্যবস্থা আছে। আর এসব কিছু সেরে পড়ন্ত বেলায় জিওথারমাল স্পা তে গিয়ে প্রাকৃতিক গরম পানি দিয়ে তৈরী পুলে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন সারাদিনের ক্লান্তি। সেখানে এক খাবার হোটেলও আছে। সাথে খাবার না থাকলে দুপুরের খাবার কিংবা চা কফির পর্বটাও সেরে ফেলার সুযোগ রয়েছে।
প্রাচীন দুরারোহ পর্বতের গায়ে ভাঙনের ফলে সৃষ্ট গিরিখাতে মাটির নীচ থেকে ধারাবাহিকভাবে উত্তপ্ত বাষ্প উদগীরণের কারণে হেলস গেটের এই নামকরণ করা হয়। জিওথার্মাল এনার্জির এই বাষ্প বড় বড় তাপরোধক পাইপের মাধ্যমে নিকটবর্তী ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হচ্ছে। এই বাষ্প দিয়ে বিশাল আকারের সুইমিং পুলের পানি গরম রাখা হচ্ছে। পানিতে হাত ডুবালে প্রথমে মনে হয় হাত পুড়ে যাচ্ছে। সাহস করে পানিতে নেমে পড়লে অল্প সময় পরেই বেশ আরাম বোধ হয়।
পার্কের একটি বড় আকর্ষণ পাথুরে গিরিখাত আর এর স্থানে স্থানে গরম পানির ঝরণা। এই গিরিখাত সংকীর্ণ হতে হতে একসময় প্রায় গায়ে এসে লেগেছে। এখানে হাঁটতে গেলে সাথে গাইড নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। পার্কের গেটেই গাইডদের দেখা মেলে। ১০০০ থেকে ২০০০ শিলিং দিলেই এই গাইড সার্ভিস পাওয়া যায়। বর্ষায় গিরিখাতে আকস্মিক ঢল নামে। তাই শুকনো মৌসুম ছাড়া গিরিখাতের ভেতর না যাওয়াই ভালো। এছাড়াও শুকনো মৌসুমেও ওখানকার মাটি এবং দেয়াল যথেষ্ট ভঙ্গুর। সাবধানে পা না চললে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
১৯০০ সালের দিকে মাউন্ট লংগনট এর বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ছাই এখনও হেলস গেটের পথজুড়ে খুঁজে পাওয়া যায়। ন্যাশনাল পার্কের মধ্যেই ওলকারিয়া আর হবলিস নামে দুটো মরে যাওয়া আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ১৯৮৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হেলস গেট ন্যাশনাল পার্ক সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়।
কেউ যদি নাইরোবিতে থেকে আশপাশে বেড়াতে যেতে চায়, তাহলে হেলস গেট ন্যাশনাল পার্কে অবশ্যই যাওয়া উচিত। একদিনে ঘুরে আসা কিংবা চাইলে লেক নাইভাশার আশপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন গেস্ট হাউসে বা রিসোর্টে এক রাত কাটিয়ে আসলেও হবে দারুন রোমান্চকর অভিজ্ঞতা।
জনপ্রিয়তার দিক থেকেও এই পার্কের রয়েছে বিশেষ কাটতি। বিখ্যাত সিনেমা টুম্ব রাইডার এর দৃশ্যের চিত্রায়ণ এই পার্কে হয়েছে। এছাড়াও ১৯৯৪ সালের লায়ন কিং অ্যানিমেশনের দৃশ্য চিত্রায়ণ এই পার্কের অনুকরণে করা হয়েছে।
নাইরোবি থেকে গাড়িতে হেলস গেট পৌঁছতে দুই ঘন্টার মত সময় লাগে। সকাল সকাল বেরিয়ে পরলে খুব সহজেই একদিনের ট্রিপ সেরে ফিরে আসা যায়। আর মনে রাখা প্রয়োজন ট্রিপটা শুরু হবে গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই। পথে চা বাগান, কফি বাগান, রিফট ভ্যালির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, খোলা আকাশ, গ্রামের বাজার, ভিউ পয়েন্ট এসবকিছুই এই ট্রিপের অংশ হবে। আর পথে যদি থেমে থেমে যেতে চান তাহলে দুই ঘন্টার থেকে বেশি সময় লেগে যাবে।
হেলস গেট ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার জন্য টিকিট কাটতে হয়। কেনিয়ার বাসিন্দা হলে টিকিটের দাম ২৫০ কেনিয়ান শিলিং আর বাসিন্দা না হলে প্রতিজনের জন্য গুণতে হবে ২০ ডলার করে। শিশুদের জন্য এই দাম যথারীতি ২০০ শিলিং এবং ১৫ ডলার। এছাড়াও সাইকেল, মোটর সাইকেল অথবা ৬ সিটের গাড়ি ভাড়া করতে চাইলে তা ৩০০ থেকে ৭০০ শিলিং এর মধ্যে পেয়ে যাবেন।
হেলস গেট ঘুরে এসে মনে হয়েছে নরক যদি এমন হয় তাহলে এরকম নরকের দুয়ারে আমি হাজারবার যেতে রাজি আছি! প্রকৃতির অপার্থিব এই হাতছানি নিমিষেই ভুলিয়ে দেবে যাপিত জীবনের একঘেয়ে নরক যন্ত্রণা!