স্থানীয়দের সহায়তায় তৈরি হলো ম্রো শিশুদের ছাত্রাবাস ‘আরুং আনেই’

উসিথোয়াই মারমা, বান্দরবান || বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত ম্রো শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য নিজস্ব উদ্যোগে একটি ছাত্রাবাস স্থাপন করা হয়েছে। এই ছাত্রাবাসের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আরুং আনেই’, যার বাংলা অর্থ ‘উজ্জ্বল আলো’। এখানে ৫০ জন ছেলে এবং ২০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী থাকার সুযোগ পাচ্ছে।

ছাত্রাবাসটি বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতি ইউনিয়নের টংকাবতি বাজার এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে, যা জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চারপাশে রয়েছে ম্রো অধ্যুষিত গ্রাম ও চিম্বুক পাহাড়। এখানে শুধুমাত্র দুর্গম এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের রাখা হয়েছে।

উদ্যোক্তারা জানান, অনেক দুর্গম এলাকায় এখনো স্কুল নেই। অনেক শিশু শহরে এসে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে না। আবার যারা স্কুলে ভর্তি হয়, তারা মানসম্মত শিক্ষা না পাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এই কারণে শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং নিজ মাতৃভাষা শেখার সুযোগ দিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গত রোববার (১৯ জানুয়ারি) টংকাবতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো ছাত্রাবাসটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে অভিভাবকদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করা হয়। এতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং টংকাবতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।

উদ্বোধনী বক্তব্যে চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো বলেন, ম্রো সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়াতে এরকম ছাত্রাবাস আরও প্রয়োজন। আপাতত কাঠ ও বেড়া দিয়ে তৈরি করা হলেও ভবিষ্যতে জেলা পরিষদ বা উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় স্থায়ী ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ছাত্রাবাসের পাশে অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুরা পড়াশোনা করবে। আপাতত ৭০ জন শিক্ষার্থী থাকার সুযোগ থাকলেও ভবিষ্যতে এটি ১০০ জনে উন্নীত করা হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ছাত্রাবাসে কম্বল ও সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করেছেন।

ছাত্রাবাস ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং উদ্যোক্তা সিংলক ম্রো জানান, ছাত্রাবাসটি তৈরি করতে স্থানীয়দের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। কেউ বাঁশ, কেউ কাঠ, আবার কেউ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তবে এটি শুধু তৈরি করলেই চলবে না, সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সবার ঐক্য প্রয়োজন।

পারিং ম্রো, দক্ষিণ হাঙ্গর মৌজার হেডম্যান, জানান যে, এলাকার মানুষের অনুরোধে ৪০ শতক জমি ছাত্রাবাসের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখানে থেকে স্কুলে পড়ার পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষা শেখার সুযোগও পাবে।

টংকাবতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ত্বন্বী দাশ মনে করেন, ছাত্রাবাসের কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারবে এবং ভালোভাবে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারবে।

ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াঙান ম্রো বলেন, ২০০৯ সালে থানচি ও আলীকদমের মাঝখানে ‘রুংলেং থার্বা’ নামে প্রথম ম্রো ভাষার স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা শিক্ষায়ও সহায়তা করেছে। নতুন এই ছাত্রাবাসেও একইভাবে প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে ৭টা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত ম্রো ভাষা শিক্ষা দেওয়া হবে। এজন্য দুইজন ম্রো ভাষা শিক্ষক এবং বাড়ির কাজের তদারকির জন্য আরও দুইজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।

শিক্ষার্থীদের মাসিক থাকা-খাওয়া ও খাতা-কলমের জন্য ১২০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, তবে যাদের সামর্থ্য নেই তাদের জন্য অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া, ম্রো সম্প্রদায়ের প্রচলিত পাড়ায় পাড়ায় মাটির ব্যাংকে অর্থ জমার প্রথা থেকে কিছু ফান্ড নেওয়া হবে।

২০২১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বান্দরবানে ম্রো জনসংখ্যা ৫১,৪৪৮, তবে ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের মতে ২০০৫ সালের জরিপে এটি ছিল ৬৭,৩৭৬। জেলার সাত উপজেলায় ম্রো জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে এবং তাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য এই ধরনের উদ্যোগকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

উদ্যোক্তারা আশা করেন, এই ছাত্রাবাস ভবিষ্যতে আরও শিশুদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবে এবং সমাজে তাদের অবদান রাখার সুযোগ তৈরি করবে।

শেয়ার করুন