রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রোববার সমাবেশ করবে বিএনপি। প্রায় দুই বছর পর রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশে বক্তব্য দিতে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলটি বলছে, এই সমাবেশ ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে করা হচ্ছে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসা এবং এই নির্বাচন ঘিরে বিএনপির অনেক দাবি এখনো অমীমাংসিত থাকায় দলটির নেতা-কর্মীদের কাছে সমাবেশটি অন্য রকম গুরুত্ব পাচ্ছে। দলীয় চেয়ারপারসন আগামী নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে কী বার্তা দেন, তা-ই এখন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে মূল আলোচনার বিষয়।
আজ শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনতে এবং সুসংহত করতে বিএনপি কাজ করছে। বিএনপি মনে করে, জনসমাবেশ থেকে দেশের জনগণের প্রতি সে ধরনের বার্তা পৌঁছে দেবেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্যের পর অনেক নেতাই মনে করছেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে কি না, সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করবে কি না, এমন অস্পষ্ট বিষয়গুলোর অনেক কিছুই রোববারের সমাবেশে দলীয় চেয়ারপারসন স্পষ্ট করবেন। তবে কঠোর আন্দোলনের ব্যাপারে এখনই কোনো অবস্থান জানাবেন না খালেদা জিয়া। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গত কয়েক দিন আসা অনেক নেতাই মনে করছেন, দলের তৃণমূলে বিএনপির অবস্থান নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। দলীয় চেয়ারপারসনের বক্তব্যে যতটা সম্ভব সেই ধোঁয়াশা কেটে যাবে।
এই সমাবেশের আগে বেশ কয়েকবার রাজধানীতে সমাবেশ করতে চেয়ে প্রশাসনের অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হয় দলটি। এ ছাড়া দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার কারণে দলীয় কার্যক্রমে একধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়। ফলে সংবাদ সম্মেলন ও আলোচনা সভা করা ছাড়া বিএনপির তেমন কোনো দলীয় কার্যক্রম হাতে ছিল না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর এক বছরের কিছু বেশি বাকি আছে। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা, সাংসদ ও মন্ত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগকে পুনরায় নির্বাচিত করার জন্য ভোট চাইছেন। এ ছাড়া দলের নেতা-কর্মীদেরও মাঠে কাজ করার জন্য দলটির উচ্চপর্যায় থেকে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ অবস্থায় বিএনপি নেতারা মনে করছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান না থাকলে প্রস্তুতিতে দলটি পিছিয়ে পড়বে। যার প্রভাব ভোটে পড়তে পারে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সমাবেশে খালেদা জিয়া কেবল দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বার্তা দেবেন তা নয়, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতিও তাঁর আহ্বান থাকবে। তাঁরা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার গঠন নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা আছে এমন বার্তা দেবেন। আর ইসিকে বিএনপির প্রস্তাব বিবেচনার কথা বলবেন। এর বাইরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি ইঙ্গিত দেবেন।
সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগও কিছুটা নমনীয়। খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফেরার সময় নেতা-কর্মীদের নির্বিঘ্ন উপস্থিতিতে বাধা না দেওয়া, খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফর এবং সর্বশেষ এই সমাবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি প্রদান—এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের নমনীয় মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে।
‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর দাবিতে বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি আদায়ে ব্যর্থতার পর দলটি এখন ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’ গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন বিভিন্ন বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং নির্বাচন কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বরাবরই সংলাপের বিষয়টি নাকচ করে আসছেন।
সহায়ক সরকার ও সংলাপের এসব আলোচনার মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সমাবেশ করার অধিকার আছে। সামনে নির্বাচন আসছে, অবশ্যই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা হবে। সব রাজনৈতিক দল যেন সমান অধিকার ভোগ করে, সেটা নিশ্চিত করা হবে।
আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, এ বিষয়টি জানতে ইসি দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে। সংলাপে বিএনপি সাতটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে। বিএনপির দেওয়া সাতটি প্রস্তাবের বিষয়বস্তু ছিল নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার কেমন হবে, তা ইসিকে জানানো; ইসিকে আইনি ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে, নির্বাচন আইন সংস্কার করা, ভোটের অন্তত এক সপ্তাহ আগে ও পরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা এবং নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন, যতটা সম্ভব সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করে তোলা এবং গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা।
ইসিকে দেওয়া বিএনপির প্রস্তাবগুলোর বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেওয়া প্রস্তাবের পরিপন্থী। এ অবস্থায় বিএনপি সরকারের কাছে কী চায় এবং নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে—এসব বিষয়ে খালেদা জিয়া সমাবেশে সরকার ও ইসির উদ্দেশে বার্তা দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।