ধরুন, আজ আপনার বাসায় কোনো একটা অনুষ্ঠান। সেই আনন্দ আয়োজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজিয়ে দিলেন উচ্চ শব্দে গান। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি আপনার পাশের বাসায় থাকা এসএসসি পরীক্ষার্থীর কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না? এটা শুধু কোনো পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে নয়; হতে পারে পাশের ভবনে থাকা কোনো রোগী কিংবা একটি ছোট শিশুর ক্ষেত্রেও সমস্যার কারণ।
একটু মেনে চলে…
বেশ কিছুদিন আগেই ঢাকার ওয়ারীর ঘটনাটি গণমাধ্যমে সাড়া ফেলেছিল। শব্দদূষণের জের ধরে অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তার নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন আলোচনা চলতে থাকে।
আমরা অধিকাংশই এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, এমনটাই মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার। তিনি বলেন, ‘সারা বছরই আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা উৎসব উদ্যাপন করি। একইভাবে এই পুরো সময়টাতে অনেকেরই বিভিন্ন সমস্যা থাকতে পারে। অসুস্থতা থেকে শুরু করে শব্দদূষণের কারণে একজন পরীক্ষার্থী বা বয়স্ক মানুষের কিন্তু মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।’ এমনকি যাঁরা নিজেরাও এমন শব্দের মধ্যে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই আপনার নিজের এবং আশপাশের পাড়াপড়শির কথা মাথায় রেখেই কিছু নিয়মকানুন মেনে চলুন।
আজ থেকেই শুরু করুন
মেখলা সরকার বলেন, ‘সমাজে প্রত্যেক মানুষেরই বেশ কিছু নাগরিক অধিকার থাকে। আর আমরা প্রত্যেকেই চাই নিজেদের মতো করে একটু স্বস্তিতে থাকতে।’ কিন্তু সারা দিন অফিস শেষে যেই একটু চোখটা বুজলেন, তখনই আপনার ওপর তলার প্রতিবেশী দেয়ালে পেরেক ঠোকার কাজটা শুরু করলেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার মেজাজ বিগড়াবে। আর আজকাল শহরে ফ্ল্যাটবাড়িগুলো পাশাপাশি বলে এ সমস্যা আরও প্রকট। এমনকি এসব কারণে পাড়াপড়শির মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়। তাই মেখলা সরকার মনে করেন, অন্যের ওপর দোষ দেওয়ার পরিবর্তে আগে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করুন।
এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় আপনি অনায়াসেই মেনে চলতে পারেন:
* অন্যের ওপর দোষ দেওয়ার পরিবর্তে আগে নিজের ভুলটা কোথায় সেটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করুন। আপনি হয়তো বিরক্ত। কেননা, আপনি যাঁকে চেনেনও না, সেই মানুষটি এসে আপনার বাড়িওয়ালার কাছে অভিযোগ করে গেল। কিন্তু আপনি আগে তাঁর সমস্যাটা শুনুন।
* আপনি নিজেও একজন সচেতন নাগরিক
মনে রাখুন, সমাজের প্রতি আপনার নিজেরও দায়িত্ব রয়েছে। অপরদিকে আপনার যেমন এখানে কিছু অধিকার আছে, তেমনি অন্য মানুষটিরও আছে। তাই আপনার আনন্দ যেন কারও ক্ষতির কারণ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
* তাই বলে কি উৎসব উদ্যাপন করা যাবে না?
কেন নয়? আপনি ভলিউমটা কমিয়ে দিলেই পারেন। কিন্তু সমস্যা বাধে যখন ফ্ল্যাটের ছাদে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সে ক্ষেত্রে যিনি অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন, তিনি সবার সুবিধা-অসুবিধা জেনে নিয়েই আয়োজন করবেন। সাধারণত ফ্ল্যাটে নির্দিষ্ট কমিটি থাকে। অনুষ্ঠানের আগেই সেখান থেকে অনুমতি নিতে পারেন।
* আপনিও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন
অনুমতি মিললেও শব্দের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সাধারণত শব্দের সহনীয় মাত্রা ৪০ থেকে ৭০ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকাগুলোতে এটি আরও কম হওয়া জরুরি। এর চেয়ে তীব্র শব্দের ফলে আপনার নিজেরও শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, মাথাব্যথা, খিটখিটে ভাব—এমনকি মস্তিষ্কের নার্ভেও সমস্যা হতে পারে। বৈজ্ঞানিকভাবেই এটি প্রমাণিত। যাঁরা অতিরিক্ত শব্দদূষণের মধ্যে থাকেন, একটা নির্দিষ্ট সময় পর তাঁদের এসব সমস্যা দেখা দেয়।
* আইনকানুন মেনে চলুন
শব্দদূষণে কারও সমস্যা হলে তিনি কিন্তু সহজেই আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। রাত ১০টার পর এটি প্রযোজ্য।
* শুধু ঘরেই নয়
আপনার গাড়িচালককেও সচেতন করে তুলুন এ বিষয়ে। যানবাহনের বাইরে থাকা পথচারীদের জন্য হর্নের শব্দ ক্ষতিকর। এতে পরিবেশেরও ক্ষতি হয়।
* সমানুভূতি তৈরি করুন
খুব সহজ ভাষায় নিজেকে অন্যের স্থানে নিয়ে চিন্তা করুন। আপনিও তো অসুস্থ থাকতে পারেন। তখন নিশ্চয়ই আপনারও এমন হট্টগোল ভালো লাগবে না।
* পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকেই শেখান
আপনার বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই নিয়মকানুন শেখানোর চেষ্টা করুন। শহরে খেলাধুলার জায়গা কম থাকায় শিশু বা কিশোরেরা ঘরেই বিভিন্ন খেলার আয়োজন করে থাকে। কিন্তু সেটা হতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। কেননা, তাদের খেলাধুলার শব্দে নিচতলায় থাকা প্রতিবেশীর যাতে কোনো সমস্যা না হয়।
* একইভাবে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ যেমন মসলা বাটা, দেয়ালে পেরেক ঠোকা বা আসবাব সরানোর কাজগুলো সন্ধ্যার মধ্যেই করে ফেলুন। প্রয়োজনে কমিটি এবং আপনার প্রতিবেশীকে জানিয়ে রাখুন।
* একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে রাখুন, আপনার আনন্দ যাতে কারও ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়!