বয়স আঠারো পেরোয়নি। স্বপ্নগুলো তার পুরোপুরি তৈরি হয়নি। সবে দানা বাঁধছে। ঠিক এ সময়ই হুট করে এক ‘লন্ডনি’ পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল রিমি বেগমের (ছদ্মনাম)। বিয়েটা সামাজিকভাবেই হয়েছে। তাই এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না।
সমস্যাটা তৈরি হলো তখন, যখন রিমি বেগম জানতে পারলেন তার সঙ্গে বিয়েটা ছিল প্রতারণামূলক। কিন্তু ততদিনে বেশ বেলা গড়িয়ে গেছে। মুঠোয় ধরা স্বপ্নটা হাত থেকে হঠাৎ ফসকে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
রিমির বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার টেংরা গ্রামে। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট রিমি বেগম তখন রাজনগর ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। প্রতারক ঘটকের ফাঁদে পড়ে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার এক লন্ডনি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তার।
বিয়ের কিছুদিন পরই রিমি বেগমের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে (রিমি) লন্ডনে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান। লন্ডনে নেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন কাগজে তার স্বাক্ষর নিয়ে নেন। সেই সঙ্গে রিমির ভাইদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা চাপ দিয়ে আদায় করেন। কিন্তু এর পরই রিমিরা টের পান ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন তারা। বাবা-মা হারানো রিমি তখন পাগলপ্রায়। তার ভাইয়েরা জমিজমা বিক্রি করে টাকা দিয়েছিলেন। তারাও রাস্তায় বসে পড়েন।
প্রতারক চক্র তছনছ করে দেয় তাদের পরিবারটিকে। কয়েক মাস আগে সিলেটের বিয়ানীবাজারের এক লন্ডনপ্রবাসী বৃদ্ধ তার প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য এক এক করে ঘরে আনেন তিন পুত্রবধূ। নিজের প্রাসাদোপম অট্টালিকায় তাদের আটকে রাখেন। একপর্যায়ে পুত্রবধূদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলে পুত্রবধূরা তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন।
শ্বশুরকে যেতে হলো কারাগারে। এরই কিছুদিন আগে সিলেট শহরের একটি বাসায় বিয়ের আসর থেকে ভুয়া লন্ডনি কন্যা চাঁদনি বেগম (২০), ঘটক সোহেল (৩৫) ও রুনু বেগমকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।
এর আগে ১৮তম বিয়ে করতে যাওয়ার সময় ১৭তম স্ত্রীসহ জনতার হাতে ধরা পড়েন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার মোস্তফাপুর গ্রামের লন্ডনপ্রবাসী মইনুল ইসলাম। সিলেট নগরের একটি হোটেলে তৃতীয় বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার স্বজনদের সহযোগিতায় যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আবদুল বাছিত চৌধুরী (৪০), তার পিতাসহ ছয়জনকে আটক করে পুলিশ।
লন্ডনের মায়াময় স্বপ্ন আর স্বপ্নের লন্ডনের মায়াজাল ছড়িয়ে সিলেট অঞ্চলজুড়ে এখন ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে ‘লন্ডনি বিয়ে’ বাণিজ্যের অভিনব প্রতারণার ফাঁদ। যুক্তরাজ্যের ‘সিটিজেন’ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রবাসীদের সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসরত বিয়েযোগ্য ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার নাম করে ভদ্রবেশী এসব প্রতারক ভেঙে দিচ্ছে হাজারো তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন। হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
বিয়ের নামে এমন নির্মম প্রতারণার সঙ্গে কিছু বিকৃত রুচির প্রবাসীর পাশাপাশি জড়িত রয়েছে বিয়ের ঘটক ও ম্যারেজ মিডিয়া নামধারী প্রতারক চক্র। এসব প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সিলেটের চার জেলার হাজারো তরুণ-তরুণী ও তাদের পরিবার আর্থিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধান ও ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, সিলেট বিভাগজুড়ে শুধু লন্ডনি বিয়ের ঘটকালির নামে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দেশে সক্রিয়। তারা বিয়েযোগ্য সুন্দরী ও সুদর্শন তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে সিটিজেন বিয়ের নাম করে কয়েক লাখ টাকার চুক্তি করে মাঠে নামে। একইভাবে মৌলভীবাজার শহরের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তার কলেজপড়ুয়া কন্যা সোনিয়ার (ছদ্মনাম) বিয়ে হয় নবীগঞ্জের এক যুক্তরাজ্যপ্রবাসী যুবকের সঙ্গে।
বিয়ের পর জানা যায়, লন্ডনের ম্যানচেস্টারে সোনিয়ার স্বামীর স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। স্বামী লন্ডন ফিরে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে সোনিয়ার সঙ্গে সব যোগাযোগই বন্ধ যায়। বিয়ের সাত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও স্বামীর ফেরার পথ চেয়ে এখনো অপেক্ষায় রয়েছেন সোনিয়া। লন্ডনপ্রবাসী পরিবারে বিয়ে হলে ছেলে-মেয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকবে, এমনকি অভিভাবকরাও পাবেন কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার-পাউন্ড এমন প্রলোভনের ফুলঝুরি ছড়িয়ে প্রলুব্ধ করা হয় অভিভাবকদের।
বিনিময়ে বিয়ের আগেই প্রবাসী বর-কনেদের মামা, চাচা, খালা বা ভাইবোনদের দেওয়ার কথা বলে বিয়ের আগেই আদায় করে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতারক চক্র ভুয়া লন্ডনি বর-কনে সাজিয়েও প্রতিনিয়ত বিস্তৃত করছে প্রতারণার ফাঁদ। এ ছাড়া ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর অনেক প্রবাসী বৃদ্ধ দেশে এসে অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে করেন। আবার আগের দু-তিনটি বিয়ে গোপন করে অনেক লন্ডনি কন্যা দেশে এসে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এমন অভিযোগও কম নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সবার আগে আমাদের সমাজে, অভিভাবক মহলে সচেতনতার দরকার। আর বিদেশে জন্ম নেওয়া বা বড় হওয়া তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের মানসিকতার বা চিন্তার দূরত্ব থেকে যায়। সে কারণেই এসব বিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভেঙে যায়।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন