মোবাইল ফোন অপারেটরদের জন্য অভিন্ন ভয়েস কলরেট নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ ব্যাপারে বলেন, বর্তমানে মোবাইল ফোন অপারেটরদের অফনেট (এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটর) ও অননেট (একই অপারেটরের নেটওয়ার্ক) কলরেটের পার্থক্যের ফলে বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে অপেক্ষাকৃত কম গ্রাহকের অপারেটরদের ক্ষতি হচ্ছে। গ্রাহকরাও পড়ছেন বিভ্রান্তিতে। তাই কলরেটে সমতা আনতে বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিটিআরসি সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিটিআরসি কলরেট পর্যালোচনার কাজ শুরু করেছে।
এর আগে ২০১৭ সালের জুন-জুলাইয়ে বিটিআরসি অফনেট ও অননেট কলের বৈষম্য কমিয়ে আনতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে প্রস্তাবনা দিয়েছিল। তখন বিভাগ এ প্রস্তাবনা ফেরত পাঠিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, অফনেট-অননেট কলের বৈষম্য থেকে সুবিধাভোগী একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের স্বার্থ রক্ষা করতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ তখন বিটিআরসির এ উদ্যোগ ভেস্তে দিয়েছিল। বিটিআরসির প্রস্তাবনা পাস হলে কলরেট বাড়বে বলে বিশেষ সুবিধাভোগী একটি অপারেটর তখন কৌশলে ভুয়া গবেষণা তথ্য প্রচার করে বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে গ্রাহকরা বিভ্রান্তিকর বিভিন্ন প্যাকেজের মায়াজালে জড়িয়ে প্রতারিত হওয়ার হাত থেকেও রেহাই পাবেন।
এ প্রসঙ্গে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবীর সমকালকে বলেন, বিশ্বে অন্য কোথাও অফনেট-অননেট কল রেট নেই। বিশ্বমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলরেট অভিন্ন হলে অবশ্যই ভালো হবে। তবে নতুন কলরেট নির্ধারণে গ্রাহকপ্রতি অপারেটরদের রাজস্ব এবং বাজারে অন্য সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা উচিত।
অফনেট-অননেট কলের বৈষম্য: ২০১২ সালে নেওয়া বিটিআরসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমানে অননেটে সর্বনিম্ন কলরেট ২৫ পয়সা এবং অফনেটে সর্বনিম্ন ৬০ পয়সা। উভয় ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কলরেট ২ টাকা। অর্থাৎ, একই নেটওয়ার্কের মধ্যে একটি অপারেটর ২৫ পয়সা থেকে দুই টাকার মধ্যে এবং অন্য অপারেটরের নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে ৬০ পয়সা থেকে ২ টাকার মধ্যে কলরেট নির্ধারণ করতে পারবে। বিদ্যমান চারটি অপারেটরের বর্তমান কলরেট প্যাকেজ বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ গ্রাহকের মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন বর্তমানে অননেট কল অর্থাৎ গ্রামীণফোন টু গ্রামীণফোনে কলের ক্ষেত্রে এক টাকা ২০ পয়সা কলরেট আদায় করছে। অফনেটে গ্রামীণ ফোন নিচ্ছে এক টাকা ৫৭ পয়সা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্রাহকের অপারেটর রবি ও এয়ারটেলের একীভূত ‘রবি’র অননেট কলরেট ৩৫ পয়সা এবং অফনেট ৯১ পয়সা। এ ছাড়া বাংলালিংকে গ্রাহকদের জন্য অননেট ৩৯ পয়সা এবং অফনেট ৮৯ পয়সা এবং টেলিটকে অননেট ৩৪ পয়সা এবং অফনেট ৮৬ পয়সা কলরেট নেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সরকার নির্ধারিত ভ্যাট ও অন্যান্য কর মিলিয়ে আরও প্রায় ২৪ শতাংশ। অফনেটের ক্ষেত্রে ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ-আইসিএক্স অপারেটরের ৪ পয়সা মূল্য যোগ হয় প্রতি মিনিট কলে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গ্রাহক সংখ্যা বেশি হওয়ায় গ্রামীণফোনে সঙ্গত কারণেই অননেট কল বেশি। আবার অন্য অপারেটর থেকেও বেশি ইনকামিং কল হচ্ছে এই অপারেটরের নেটওয়ার্কেই। পাশাপাশি এ মুহূর্তে অননেট এবং অফনেট উভয় ক্ষেত্রেই গ্রামীণফোনের কলরেটই সবচেয়ে বেশি। বিটিআরসি সংশ্নিষ্ট সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, সর্বনিম্ন কলরেট ২৫ পয়সা ধরলে গ্রামীণফোনের গড় কল হিসাবে শুধু অননেট কল থেকেই মাসিক আয় ২৮০ কোটি ১৫ লাখ টাকা, রবির আয় ১১২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং বাংলালিংকের ৭১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে টেলিটকের মাসে আয় হয় মাত্র দুই কোটি ৩২ লাখ টাকা।
এ বৈষম্য কমাতে ২০১৭ সালের জুন-জুলাই মাসে বিটিআরসি অননেটে সর্বনিম্ন রেট ৩৫ পয়সা এবং অফনেট ৪৫ পয়সা
এবং সর্বোচ্চ কলরেট দুই টাকা থেকে কমিয়ে এক টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। বিটিআরসির ওই প্রস্তাবনা কার্যকর হলে অননেট কলরেটে প্রভাব পড়ত না, কিন্তু অফনেট কল বর্তমানের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসত। বিশেষ করে কোনো অপারেটর এক টাকা ৫৭ পয়সা অফনেট কল নির্ধারণের সুযোগ পেত না। কিন্তু তখন অননেট কলের হার সর্বনিম্ন স্তরে ১০ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব সামনে নিয়ে এসে এবং অফনেট কলের হার ১৫ পয়সা কমানোর প্রস্তাব গোপন করে একটি বিভ্রান্তিকর বেনামি কলরেট বিশ্নেষণ গবেষণা ছড়িয়ে দেয় বিশেষ সুবিধাভোগী একটি অপারেটর। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এতে বিভ্রান্ত হয়ে বিটিআরসির প্রস্তাবনা ফিরিয়ে দেয়।
নতুন উদ্যোগ জটিলতা কমাবে: বিদ্যমান অননেট-অফনেট কলরেটের জটিলতার কারণে গ্রাহকরা নানা প্যাকেজের মায়াজালে প্রতারিত হচ্ছেন। প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির সমকালকে বলেন, প্যাকেজের এত সমাহার অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। কারণ সেখানে অননেট-অফনেটের এই অদ্ভুত হিসাব নেই। তিনি বলেন, প্যাকেজ যত বেশি হয় গ্রাহক ঠকানো তত সহজ হয়। আর অননেট-অফনেট থাকলে একে পুঁজি করে নানা জটিল অফার দিয়ে প্যাকেজের হিসাব করাও সহজ হয়। তাই যত তাড়াতড়ি অননেট-অফনেট কলের ব্যবধান দূর হবে, তত তাড়াতাড়ি গ্রাহক বিভ্রান্তি এবং প্রতারণা কাটিয়ে ওঠা যাবে। অভিন্ন কলরেট হলে বেশি গ্রাহক সংখ্যার সুবিধা নিয়ে এককভাবে কোনো অপারেটরের একচেটিয়া বাজারের বদলে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ও গ্রাহকসেবা নিশ্চিত হবে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেন, এই মুহূর্তে গ্রাহকসেবার মানোন্নয়ন এবং সেবার ক্ষেত্রে জটিলতা কমানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর প্রথম উদ্যোগ হিসেবে গ্রাহককে প্রতারণা করার সবচেয়ে বড় উপায় ইন্টারনেটে পে পার ইউজ সিস্টেমকে সর্বোচ্চ ৫ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ, এখন কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদের নির্ধারিত প্যাকেজ ছাড়া গ্রাহকের কাছ থেকে ৫ টাকার বেশি ব্যবহারমূল্য কেটে নেওয়া যাবে না। এর ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রতারণার বড় ক্ষেত্র বন্ধ হয়েছে। এখন কলরেটে অফনেট-অননেটের বৈষম্য দূর করে অভিন্ন কলরেট নির্ধারণের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাজারে প্রতিযোগিতায় সমতা আসবে এবং গ্রাহকরাও উপকৃত হবেন।